যুক্তি যুক্তাম প্রগ্রহ্নিয়াত বালাদপি বিচক্ষণঃ।
রবেরবিষয়ম্ বাস্তু কিম্ ন দীপঃ প্রকাশয়েত।
প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে যেকোন স্থান থেকেই জ্ঞান আহরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, নিষ্পাপ শিশুর কাছ থেকেও। প্রদীপের শিখায় সেই স্থানও আলোকিত হয় যেখানে সুর্যের দীপ্তি প্রবেশ করতে অক্ষম হয়।
কোন কিছুই যে সহজে মেলে না তা জানতো এককালের বাঙ্গালী। কোন বাঙ্গালী? সেই বাঙ্গালী যার প্রথম ঘুম ভেঙেছিল ১৮৬৭-এর হিন্দু মেলার কার্যক্রমে। ক্রমশ যে দৃঢ় শরীর, অনুশাসন ও শৃঙ্খলা ছাড়া কিছু হবে না তাও বোধগম্য হল বাঙ্গালীর। প্রিয়নাথ বসু ও নবগোপাল মিত্রের ন্যাশনাল জিমনেশিয়াম, গুহ পরিবারের শক্তি চর্চা, যে আখড়ায় নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক এক যুবকের আনাগোনাও ছিল। বিদ্যাসাগর মশাইও সংস্কৃত কলেজের অভ্যন্তরে শুরু করলেন কুস্তির আখড়া, নিজেও কিন্তু ছিলেন মল্লবীর এবং সেই আখড়াতেই কসরৎ করতেন শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন।কেন হবে না!? কৌটিল্য তথা চাণক্যের আর এক নাম তো মল্লনাগ এবং সংস্কৃত অক্রবাট থেকেই করা শব্দের উৎপত্তি। শুধু ঠাকুর রামকৃষ্ণই যে যৌবনে কুস্তি করেছেন তা নয়, মহাপ্রভু চৈতন্যের শারীরিক বলও স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো, লাঠি ও অলাতচক্র চালনায় তাঁর পারদর্শিতা কিংবদন্তীসম। রাজা রামমোহন রায়ও বলী ছিলেন, তলোয়ার, বিশেষত গুপ্তি চালনায় রীতিমতো ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর।
স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত বাণী “লৌহদৃঢ় মাংসপেশী, ইস্পাতকঠিন স্নায়ু, বজ্রভীষণ মনোবল” -এর mesmerism যে কিভাবে গ্রাস করেছিল বাঙ্গালীকে তার জের সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল ব্রিটিশ। নতুবা লর্ড কার্জনের মতানুযায়ী “..with the intellect of a Greek, grit of a rabbit” বাঙ্গালীকে ভয় পাওয়ার এতো কারণই বা কি আর স্বদেশী আন্দোলনের constructive jingoism ই বা তার কাছে এতো আতঙ্ক হয়ে উঠল কেন তা শান্তভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় – প্রগাঢ় শক্তি সাধনা। শুধুমাত্র রক্তাভ/অগ্নিবর্ণ বস্ত্র পরিধান করলেই, কণ্ঠে রুদ্রাক্ষ ধারণ করলেই শক্তিবাদের মূর্ত প্রকাশ হয় না। তার সাথে প্রয়োজন শক্তিচর্চা – অমিত দৈহিক শক্তি সহকারে তীক্ষ্ণ শস্ত্রচালনার অভ্যাস – the highest stage of concentration…শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বা সোহং স্বামী এবং তাঁর শিষ্য যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা নিরালম্ব স্বামী সম্বন্ধে কি বলা যায়!? দুজনেই তো এই পথেরই পথিক। এই ত্রয় (সন্ন্যাসী) -এর গার্হস্থ্য প্রকাশই তো যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি শ্রী শ্রী বলল গিরিজীর দীক্ষিত শিষ্যও ছিলেন। বুড়িবালামের তীরে যুদ্ধের পূর্বকালে যে গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানেও তিনি সশিষ্য দৈনিক কুস্তি অভ্যাসের জন্য মাটি কুপিয়েছিলেন।
আগার শব্দটির অর্থ হল আলয়, আধার; আধার শব্দটির অর্থ হল পাত্র, আশ্রয়। বাঙ্গালী হিন্দুর ছিল দুটি আগার – গ্রন্থাগার ও ব্যায়ামাগার, প্রতি পাড়ায়। দেহের ও মগজের পুষ্টির যাবতীয় আয়োজন জাতির দেহে নতুন রক্তসঞ্চার করছে প্রত্যহ। তেজ তার ভয়ঙ্কর; তাই বাঙ্গালীকে সমূলে নাশ করতেই ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল কটি অধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় – একই বঙ্গভূমির বিভাজন হয় একই শতাব্দীর মধ্যে তিনবার – ১৯০৫, ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এবং প্রত্যেকবারই তা সম্পূর্ণ হয়েছে বাঙ্গালী হিন্দুর ধ্বংসসাধনের মধ্য দিয়েই। প্রত্যেকটি বিভাজনই আর্দ্র হয়েছে বাঙ্গালী হিন্দুর রক্তপ্লাবনে এবং প্রত্যেক স্রোতই বিনষ্ট করেছে বাঙ্গালীর মৌলিকত্বকে। যেভাবে একটি আত্মনির্ভর, সতেজ ও অমিত সম্ভাবনাময় জাতিকে ধ্বংস করা যেতে পারে, যে যে প্রক্রিয়ায় তার প্রত্যেকটাই অনুষ্ঠিত হয়েছে বাঙ্গালী হিন্দুর বিরুদ্ধে – অকথ্য অত্যাচার, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধ্বংস, স্বাধীন মনীষার অপমৃত্যু ঘটবার প্রত্যেক উপকরণের সংযোজন, বরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দের হত্যা থেকে রাজনৈতিক কদর্যতা, পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত করা, যে বিচাধারার কাছে স্বাদেশিকতা এক ঘৃণিত বস্তু তার উচ্চাঙ্গ প্রচার রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে ও সর্বশেষে সেই পদ্ধতি যা George Orwell বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর সহজাত অনুপম ভঙ্গীতে, ” The most effective way to destroy people is to deny and obliterate their own understanding of their history” ….বর্তমানে হিন্দুত্বের প্রবাহও কতটা বাঙ্গালীকে মোহমুক্ত ও পুনর্জাগরিত করতে সক্ষম হবে সে প্রশ্ন থেকে যায় – utmost sincerity/ঋজুতা, স্থিরসঙ্কল্পের পরিবর্তে ঢক্কানিনাদ ও স্তাবকতার প্রাবল্য ও অলীক অবতার তত্ত্ব – ইনিই সব করবেন, আমি শুধু জয়গান গাইবো – এর তীব্রতাই অত্যধিক।
পরিশেষে – একটি অনালোচিত অধ্যায় সেইযুগের বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের একটি প্রামাণ্য চিত্র যার flaming resistance মুসলিম লীগের নৃশংসতাকে স্তব্ধ করেছিল ভয়াল, ভয়ঙ্কর প্রত্যুত্তরের মধ্য দিয়ে। মহানায়ক উত্তম কুমারের আত্মজীবনী “আমার আমি” থেকে –
“……’৪২ সালেই ভবানীপুর সুইমিং ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হবার কারণ, যুদ্ধের সময়ে পদ্মপুকুর ওয়াটার ট্যাঙ্ক হয়ে যায়। সেই জল কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। পুলিশ মোতায়েন ছিল। এই ক’বছরে আমি ১০০ ইয়ার্ডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। শুধু আমাদের এখানে নয় – আমাদের সুইমিং ক্লাবের হয়ে যখন বাইরে যেতাম তখনও ট্রফি এনেছি। আমি যখন জল থেকে উঠে আসতাম তখন আমাকে নাকি জনি ওয়াশিমুলারের মতো দেখাতো। বুক থেকে কোমর পর্যন্ত এমনকি আমার জলে ভেজা মুখটাও নাকি তাঁর মত ছিল, সবাই বলত! আমি নিজেও অবশ্য সেই কিংবদন্তী সাঁতারুর অনুরাগী ছিলাম।
সেই সাঁতারের সঙ্গে আবার কুস্তি। এসব শুনলে হয়তো অনেকেরই বিশ্বাস হবে না। তা না হবারই কথা, কারণ ইদানিংকালের ছেলেরা দশ-এগারো বছর বয়সে এক সঙ্গে এতগুলো কাজ করতে পারে না – তাদের স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ নেই। আমাদের ছিল। আমাদের মানসিক গঠনও তেমনি ছিল, যেমন ছিল আমাদের পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া। আমি ইন্দিরা সিনেমার পিছনে যে বিখ্যাত ননীবাবুর আখড়া ছিল সেখানে গিয়ে নিয়মিত কুস্তি শিখতাম। ননী ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর। লালুদের এই কুস্তি ভালো লাগতো না। আমি কিন্তু কুস্তিকে ভালোবাসতাম। রোজ ভোরে উঠে আখড়ায় চলে যেতাম, কুস্তি শেখার পর ভোম্বলদার কাছে লাঠি খেলা শিখতাম।ভোম্বলদার মতো দুঃসাহসিক লোক আমার আর নজরে পড়েনি। তিনি একই দশজনের সঙ্গে লড়ে জিততে পারতেন। প্রয়োজন হলে দোতলা থেকে নীচে লাফ দিয়ে পড়তে পারতেন। যেমনি ছিল তাঁর স্বাস্থ্য তেমনি ছিল তাঁর বুক। আমাকে লাঠি খেলা-কুস্তিতে ভোম্বলদা অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ….এরপর যখন সাউথ সুবার্বনে পড়ছি তখন সেটা ১৯৪১ সাল, আমরা নিজেরাই একটা ব্যায়ামাগার তৈরী করে ফেললাম। লুনার ব্যায়ামাগার। ভোম্বলদা বললেন, শুধু ব্যায়ামাগার হলেই হবে না, সেই সঙ্গে ফুটবল খেলার ব্যবস্থাও করতে হবে…..”….
Juvenal -এর “Mens Sana in Corpore Sano”/ A Healthy Mind in a Healthy Body যার মর্মবাণী আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয় সুপ্রাচীন বৈদিক “শরীরমাধ্যম খলু ধর্মসাধনম” বা “শাপাদাপি শারাদাপি”/জ্ঞানের শক্তির চর্চা, শক্তির জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে তা আজ মৃত এই পতনোদ্যত, শিড়দাঁড়াহীন, ক্ষীণ বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে। অতএব, বাঙ্গালী হিন্দুর পুনরুত্থান এক দুরূহ সাধনা যার জন্যে অতীব বলশালী, তীক্ষ্ণধী, ধৈর্য্যশীল সাধকের বা সাধক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন সর্বাগ্রে।
শ্রী অনিমিত্র চক্রবর্তী হলেন একজন সাংবাদিক ও বিভাগীয় লেখক (columnist) এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here