সংস্কৃতি

কলমচিদের আড্ডাখানায়- ৭

(ষষ্ঠ পর্বের পর)

প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভালো যে মিত্র ও ঘোষ সংস্থায় ১ বৈশাখের সকালে লেখক-পাঠক-প্রকাশক- কর্মী এই বিভিন্ন ধরনের মানুষের এক মহা সম্মেলন হয়। প্রবীণ ও নবীন লেখক লেখিকাদের পারস্পরিক আলাপন এই দিনের সর্বাপেক্ষা বড় প্রাপ্তি। নলিনীকান্ত সরকার, লীলা মজুমদার, ডা.নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ড. প্রতুল চন্দ্র গুপ্ত, আনন্দ গোপাল সেনগুপ্ত, সমরেশ মজুমদার, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অনিতা অগ্নিহোত্রী,কিন্নর রায় আরও আরও কতজন।যে খেরোর খাতার কথা আগেই বলেছি সেখানে একবার নলিনীকান্ত সরকার লিখলেন,
‘ হেসে নাও দুদিন বই তো নয়’
তারপরই লীলা মজুমদার লিখলেন,
‘ হাসি অত শস্তা নয়’।

যখন নববর্ষ আড্ডার প্রসঙ্গ চলেই এল তখন দেজ পাবলিশিং, আনন্দ পাবলিশার্স, করুণা প্রকাশনী,সাহিত্যম প্রভৃতি সংস্থার হালখাতার কথা উল্লেখ করতেই হবে। এসব প্রকাশনা সংস্থার অফিসে নববর্ষের সকালে দেখেছি নিমাই ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব গুহ, প্রফুল্ল রায়,সমরেশ মজুমদার, কৃষ্ণা বসু,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিককে। আসতেন নারায়ণ সান্যাল। অনেক উদগ্রীব পাঠক-পাঠিকা প্রিয় সাহিত্যিকদের কাছে এসে সদ্য কেনা বইতে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে যান।ডাব, সন্দেশ, মিষ্টি ইত্যাদির মৌতাতে সে এক অনাবিল আনন্দ।

বেঙ্গল পাবলিশার্সের কর্ণধার ছিলেন ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসের অমর স্রষ্টা মনোজ বসু। প্রতিবছর তিনি নিজের জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালন করতেন। দক্ষিণ কলকাতায় বালিগঞ্জ লেকের কাছে তাঁর বাড়ির ছাদে ওইদিন প্রবীণ ও নবীন লেখকদের ঘটা করে খাওয়াতেন। সারাদিন আড্ডা ও রঙ্গ রসিকতা চলতো। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল,বনফুল,আশুতোষ মুখোপাধ্যায়,প্রমথ নাথ বিশী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়- কে না আসতেন সেদিন। বাংলা সারস্বত সমাজের সে এক মহা সম্মেলন।

আনন্দবাজার পত্রিকা দপ্তরের বিভিন্ন ঘরের আড্ডার কথা বলতেই হয়। ওই পত্রিকার দপ্তরে রবিবাসরীয় বিভাগের প্রধান ছিলেন রমাপদ চৌধুরী। তাঁর ঘরে ভিড় জমাতেন নানা বয়সের সাহিত্যিক। দীর্ঘ দেহী সুপুরুষ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রায়ই চলে আসতেন। শ্রীপান্থ সকলের কাছে তাঁর গবেষণাধর্মী রচনার জন্য যথেষ্ট সমাদৃত হতেন।সমরেশ বসু আসতেন সিল্কের ধুতি ও পাঞ্জাবি পরে। তিনি এলে এই ঘরের চেহারাটাই বদলে যেতো।কবিতা সংক্রান্ত কোন ব্যাপার নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনার জন্য আসতেন বর্ণরঞ্জিত বা বাটিক প্রিন্ট হাওয়াই শার্ট গায়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তারাপদ রায় পরিচিত ছিলেন টর্পেডো রায় নামে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ব্যক্তিত্ব ছিল দেখার মতো। তাঁর কথাবার্তায় চিন্তার ছাপ ছিলো।সুঠাম চেহারার প্রবাসী সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সুন্দর ব্যবহারের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।হাসিখুশী এবং সুরসিক হিমানীশ গোস্বামীর রসবোধ আকৃষ্ট করতো সকলকেই।রমাপদ চৌধুরীর ঘরে এমনই এক আড্ডার আসরে নিউজ প্রিন্টের পাতা ছিঁড়ে ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী লিখে ফেলেছিলেন,
” বুদ্ধদেব গুহ, গাম্ভীর্যের ব্যূহ
ঠোঁটের কোণে পাইপ জ্বলে,ট্রিগার কলম সমান চলে
সাহিত্যের জগতে পরে হবেন মহীরূহ”

( ক্রমশ)

Comment here