প্রথম পর্ব –
( ‘I climbed the steps of life and did not waste a moment . I reached the top and looked down ; I saw I had ruined myself .’ ——- পুত্র অভিজিত বড়ুয়াকে প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া )
উপক্রমণিকা –
কোচবিহার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের সভায় সার্বভৌম নামে এক মৈথিলি পণ্ডিত ছিলেন । বিশ্বসিংহ রাজা হলেও যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সার্বভৌম’র বিশেষ ভূমিকা থাকতো । সার্বভৌম যখন বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেন, তখন তাঁরই পরামর্শক্রমে নরহরি নামে এক মৈথিলি কায়স্থকে বিশ্বসিংহ নিজের মন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করেন । এই নরহরিই গৌরীপুরের রাজবংশের ঊর্ধতন পুরুষ । তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কবীন্দ্র হলেন গৌরীপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । নবম শতকের মধ্যভাগে যে গৌরীপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় তা সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছোয় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে। প্রমথেশের প্রপিতামহ বীরেন্দ্রচন্দ্রের মৃত্যুর পর প্রমথেশের পিতামহ প্রতাপচন্দ্র ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে আসামের রাঙামাটি থেকে গৌরীপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । রাজা প্রতাপচন্দ্র এবং রাণী ভবানীপ্রিয়ার কোন সন্তান ছিল না । তাঁরা ঘড়িয়াল ডাঙা’র রাজকিশোর বড়ুয়ার সন্তান প্রভাতচন্দ্রকে দত্তক গ্রহণ করেন । প্রভাতচন্দ্র, বড়ুয়া বংশের অন্যতম বিখ্যাত এবং কৃতী পুরুষ ছিলেন । তাঁর আমলে অজস্র জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় । শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ে গৌরীপুরের প্রভূত উন্নতি হয় তাঁর সময়ে । গৌরীপুরে ব্যাঙ্ক , লাইব্রেরি এবং ক্লাব তাঁর আমলে তৈরি হয় । বৃষ্টির দেশ গৌরীপুরের নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতিও তাঁর সময়ে হয় । এছাড়া সংগীতেও প্রভাতচন্দ্রের যথেষ্ট দখল ছিল । লখনৌতে দুইবার এবং কলকাতায় একবার তিনি মিউজিক কনফারেন্সের বিচারক নির্বাচিত হয়েছিলেন । তাঁর রচিত তবলাতরঙ্গিনী বইটি সঙ্গীতরসিকদের বিশেষ প্রশংসা লাভ করেছিল । যদিও আধুনিক বাদ্যযন্ত্র যেমন হারমোনিয়ামের প্রতি তাঁর বিরাগ ছিল ।১৮৯৬ সালে প্রভাতচন্দ্রের সঙ্গে সরোজবালা দেবীর বিবাহ হয় । সরোজবালা ছিলেন কায়স্থ বৈষ্ণব বংশের মেয়ে । দলকুমার ছত্রের প্রতিষ্ঠাতা শংকরদেবের বংশের কন্যা তিনি । কথিত আছে দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থাকার পর ১৯০৩ সালে আগ্রায় এক সাধুর আশীর্বাদে ওই বছরের ২৪ শে অক্টোবর প্রমথেশের জন্ম হয় । তবে প্রমথেশচন্দ্রই যে প্রভাতচন্দ্রের প্রথম সন্তান সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে । কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে প্রমথেশের জন্মের আট বছর আগে প্রভাতচন্দ্রের এক সন্তান জন্মায় যে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই মারা যায় ।প্রমথেশের ডাকনাম ছিল মণি । প্রমথেশের পরে প্রভাতচন্দ্রের আরও দুটি সন্তান হয় , যার মধ্যে দুটি পুত্র এবং দুটি কন্যা । পুত্র দুজন হলেন প্রকৃতীশচন্দ্র, ডাকনাম লালজী । ইনি হাতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন । বুদ্ধদেব গুহ এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখায় এঁর উল্লেখ আছে । এরপরের সন্তান ছিলেন প্রণবেশচন্দ্র বড়ুয়া, ডাকনাম পুটলি । এ ছাড়া প্রমথেশের দুটি বোন হলেন যথাক্রমে নীহারবালা ও নীলিমা সুন্দরী ।
ছেলেবেলা –
প্রমথেশের পড়াশুনা শুরু হয় গৃহশিক্ষকের কাছে । রাজবাড়ির সেটাই রেওয়াজ ছিল । আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর শিক্ষক । আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পড়াশুনা ছাড়াও তিনি কীর্তন শেখেন । তিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও সঙ্গীত শিক্ষা করেন । যদিও তিনি পরে গান করেছেন বলে শোনা যায়নি । কিন্তু অনেকদিন পরে যখন তিনি নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে যুক্ত, তখন একটি আসরে রবীন্দ্রনাথের ‘ গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ তাঁর গলায় শুনে কে এল সায়গল পর্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন ।
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন স্বল্পাহারী । কথিত আছে আট বছর বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র গোদুগ্ধ পান করে তিনি বড় হয়েছিলেন । তাও এমনি দুধ নয়, গোরুর বাঁট থেকে সদ্যনিঃসৃত দুধ । ন’ বছর বয়সে তিনি যখন প্রথম ভাত খান সেদিন সারা গৌরীপুর জুড়ে উৎসব হয়েছিল । ন’ বছর বয়স থেকে তাঁর খাদ্য ছিল ফেনাভাত , সঙ্গে কড়া করে ভাজা আলু , কড়াইশুঁটি , বাঁধাকপি সিদ্ধ , তাতে বেশ খানিকটা ঘানির সর্ষের তেল । এর সঙ্গে ‘তুলিয়া’ লেবু ছিল তাঁর খাদ্যতালিকার অপরিহার্য বস্তু । কিছুদিন পরে ভাতের সঙ্গে খেতেন ডাল , শাকভাজা , কড়কড়ে করে ভাজা আলু । রাতে লুচি আর দু’টুকরো মাংস । এছাড়া খিচুড়ি আর জিলাপি খেতে ভালোবাসতেন । বিলাতে গেলে সিদ্ধ সবজি , স্যুপ খেয়েই থাকতেন । জীবনে বিলাতে গেছেন মোট এগারোবার ।
বিবাহ –
প্রমথেশের পড়াশুনা কলকাতায় হেয়ার স্কুলে । তারপরে প্রেসিডেন্সি কলেজে । ১৯২৪ সালে প্রমথেশ পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন । এর আগে ১৯২১ সালে প্রমথেশের বিবাহ হয় বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ার বিখ্যাত মিত্র বাড়ির মেয়ে মাধুরীলতার সঙ্গে । এই বিয়ে সুখের হয়নি । কারণ বিয়ে হয়েছিল প্রমথেশের মা সরোজবালার পছন্দক্রমে । যদিও মাধুরীলতা ছিলেন আদর্শ হিন্দু স্ত্রী । স্বামীর যাবতীয় ব্যভিচার নীরবে সহ্য করেছেন । প্রমথেশের দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান অরূপকে মানুষ করেছেন । সে প্রসঙ্গে পরে আসছি । প্রমথেশের বিদেশে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল , কিন্তু মায়ের বাধায় তা আর সম্ভব হয়নি ।
প্রথম জীবনে অভিনয় –
গৌরীপুরের রাজবাড়িতে নাটকের অভিনয়ের নিয়মিত চর্চা ছিল । গৌরীপুরে প্রমথেশের নির্দেশনায় যে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় তা হল ‘খাসদখল’ । ওই বছরই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ মঞ্চস্থ হয় । ১৯২০ সাল থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত অভিনয় হয়েছে গৌরীপুরের বাড়িতে । বছরে গড়ে তিনটে করে নাটক হয়েছে । ১৯২০ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘ষোড়শী’ । জীবানন্দের ভূমিকায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় এত ভাল লেগেছিল প্রমথেশের যে তিনি এগারোবার নাটকটি দেখেছিলেন এবং নিজে গৌরীপুরে ফিরে গিয়ে ওই ভূমিকায় নিজে অভিনয় করেন । ১৯২০ সালে প্রমথেশের নির্দেশনায় আরও যে দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয় তা হল ‘ইরানের রাণী’ আর ‘সমাজ’। পরের বছর মঞ্চস্থ হয় তিনটি নাটক —- ‘দুর্গাদাস’ , ‘ বিরাজ বৌ’ , এবং ‘ ফেলারামের স্বাদেশিকতা’ । ১৯২২ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘ফুলশর’ , ‘সিংহল বিজয়’ আর ‘নুরজাহান’ । ১৯২৩ এবং ১৯২৪ সালে প্রমথেশের পড়াশুনার কারণে নাটকের সংখ্যা কম , দুটি করে প্রতি বছরে । অভিনীত নাটকগুলি হল —- ‘ প্রফুল্ল’ , ‘বঙ্গনারী’ , ‘বিবাহ বিভ্রাট’ এবং ‘’কিন্নরী’।
১৯২৯ সাল, নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ । তখন কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যেমন ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি , যিনি ‘ডিজি’ বলে সমধিক পরিচিত , বিখ্যাত পরিচালক দেবকী কুমার বসু , দিনেশ রঞ্জন দাশ প্রমুখেরা ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন্স ফিল্ম কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন । ডিজির সঙ্গে প্রমথেশের পরিচয় হয়েছিল শান্তিনিকেতনে । প্রমথেশ খুব স্বল্প সময়ের জন্য শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা করেছিলেন । ডিজি একদিন প্রমথেশকে ছবির শুটিং দেখার জন্য আমন্ত্রণ করলেন । ছবির নাম ‘পঞ্চশর’ । পরিচালক দেবকী কুমার বসু । নায়িকা মলিনা দেবী । সাড়ে চুয়াত্তরে তুলসী চক্রবর্তীর বিপরীতে যিনি ফাটাফাটি অভিনয় করেছিলেন সেই পৃথুলা মলিনা তখন তন্বী যুবতী । যেদিন প্রমথেশ শুটিং দেখতে এলেন সেদিন মলিনা বন্দুক চালাবেন এমন একটি দৃশ্য ছিল । আনাড়ি মলিনাকে ভুল্ভাবে বন্দুক ধরতে দেখে প্রমথেশ সংশোধন করতে গেলেন , মলিনা বিরক্ত হয়ে তাঁর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। তাই দেখে ডিজি ছুটে এলেন মলিনাকে বললেন ‘কার দিকে অমন চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছো । জানো উনি গৌরীপুরের রাজকুমার ।‘ অপ্রতিভ মলিনা ভয়ে , লজ্জায় জড়োসড়ো । সেদিন ওই বন্দুকটি প্রমথেশই চালিয়ে দেন । যদিও ছবিতে তাঁর হাতটুকু শুধু দেখা গিয়েছিল । এরপরই প্রমথেশ চলচ্চিত্রের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন । পরের ছবি ‘টাকায় কী না হয়’ , ইংরাজী নাম ‘মানি মেকস হোয়াট নট’ ( তখন ছবির এরকম বাংলা ইংরাজী দু’রকম নাম হত , যেমন উপরে উল্লেখিত পঞ্চশরের নাম ছিল ব্লাইন্ড গড) – এ প্রমথেশ একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন । সহ-অভিনেত্রী ছিলেন আইরিশ গ্যাসপার , যিনি সবিতা দেবী নামে পরিচিত ছিলেন । একটি গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, যে দৃশ্যে প্রমথেশের ক্যাডিলাক গাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিল । কিন্তু শুটিঙয়ের সময় দেখা গেল একদিনের কাজের চিত্রায়নে সাতদিন লেগে গেল এবং সবিতা প্রমথেশের কন্ঠলগ্না হয়ে পড়লেন । সেযাত্রা প্রমথেশের বন্ধু নির্মলকুমার বরকাকতির হস্তক্ষেপে প্রমথেশ এই প্রণয়জাল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন । কারণ ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মসের পরবর্তী ছবি শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীনে তিনি আর করেননি । চরিত্রহীনের কাস্ট ছিল । উপেন — দেবকীকুমার বসু , সতীশ —- প্রমথেশ , কিরণময়ী —- সবিতা দেবীঅর্থাৎ আইরিশ গ্যাসপার এবং বিহারী —- দিনেশরঞ্জন দাশ । এই সময় প্রমথেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন , তাঁর কিডনিতে স্টোন ধরা পড়ে । তিনি বিদেশে চলে যান । তবে ছবিটি হওয়া সম্ভব ছিল না কারণ প্রবল লোকসানের মুখে পড়ে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি উঠে যায় । প্রমথেশ বিলেতে এলস্ট্রি স্টুডিওতে প্রোডাকশনের কাজ শিখতে যান । এরপর প্যারিসে সিনেমাটোগ্রাফি আর ফক্স স্টুডিওতে শিখলেন আলোর ব্যবহার । বিদেশে এইসব জায়গায় তাঁর যাতে অসুবিধা নাহয় তাই তাঁকে রেকমেন্ডেশন লেটার লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ।
দেশে ফিরে তিনি বড়ুয়া ফিল্মসের প্রতিষ্ঠা করলেন । ৪ , বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের গৌরীপুর হাউজে তৈরি হলো স্টুডিও । বড়ুয়া ফিল্মসের প্রথম ছবি ‘অপরাধী’ । অভিনয়ে প্রমথেশ বড়ুয়া , সবিতা দেবী । পরিচালনায় দেবকী কুমার বসু । সিনেমাটোগ্রাফার কৃষ্ণগোপাল । এই ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন সুশীল মজুমদার আর বিভূতি মুখার্জী , দুজনেই পরে টালিগঞ্জে অত্যন্ত সফল পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন । ঐতিহাসিক ভাবে অপরাধীর গুরুত্ব অপরিসীম , কারণ অপরাধীই প্রথম স্টুডিওর নিয়ন্ত্রিত আলোয় তৈরি ছবি । এর আগে সূর্য অস্ত গেলে বা আলোক না থাকলে পরিচালকেরা আর শুটিং করতে পারতেন না । স্টুডিওতে শুটিঙের কাজটি কিন্তু সহজে হয়নি । বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে ৪০০ অ্যাম্পিয়ারের দুটি অতিরিক্ত মিটার লাগানো হয় । প্রথমে ১০০০০ ওয়াটে শুটিং করা হলেও , নেগেটিভ ডেভেলপ করার পর কোন ছবি দেখা গেল না । এবার ২০০০০ ওয়াটে শুটিং করা হল , ফল সেই একই । শেষপর্যন্ত ৫০০০০ ওয়াটে শুটিং করার পর সফলতা এলো । সে যুগে ৫০০০০ ফিটের নেগেটিভ নষ্ট হয় । মেকআপের গণ্ডগোলের জন্য নষ্ট হয় আরও ১০০০ ফিট নেগেটিভ । অপরাধী তৈরি করতে ছয় মাস সময় লেগেছিল । ২৮ শে নভেম্বর , ১৯৩১ সালে চিত্রা টকিজে ( যা পরে মিত্রা বলে পরিচিত হয় ) অপরাধী রিলিজ হয় । অনেক পরে ১৯৫১ সালে বসুমতী পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় হেমেন্দ্র কুমার রায় প্রমথেশের এই ছবিটির অকুন্ঠ প্রশংসা করেন । প্রমথেশ বড়ুয়া ফিল্মসের ব্যানারে আরও দুটি সাইলেন্ট ছবি করেন । একটির নাম ‘নিশির ডাক’ । প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ( সুচিত্রা মিত্রের পিতা )| ‘নিশির ডাক’ অবলম্বনে তৈরি আট রিলের এই ছবিটি পরিচালনা করেন দেবকী কুমার বসু । এই ছবিটি পরে সংলাপযুক্ত অবস্থায় ১৯৪০ সালে শ্রী সিনেমা হলে রিলিজ করা হয় । সংলাপ লিখেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর সুর দিয়েছিলেন রঞ্জিত রায় । ছবিতে প্রমথেশ ছাড়াও যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা হলেন রাজলক্ষী দেবী , বিমলবাবু আর সুশীল মজুমদার । এরপরে প্রমথেশ নিজে একটি এক রিলের ছবিতে অভিনয় করেন , যার নাম ‘একদা’ । ছবিটি পরিচালনা করেন নীরেন লাহিড়ী । দুটি ছবিই ১৯৩২ সালে চিত্রা টকিজে রিলিজ হয় ।
প্রমথেশ এই সময়েই অশোকের জীবন নিয়ে একটি ছবি করার কথা ভাবেন । কিন্তু ছবির অভিনেত্রী বীণা শুটিঙে একদিন অনুপস্থিত হলে প্রমথেশ জানতে পারেন বীণা পয়সা নিয়ে একটি পার্টিতে যাওয়ার জন্য শুটিঙে আসেননি । প্রমথেশ বীণাকে বলেন “তোমার টাকার দরকার ছিল জানলে ওই কটা টাকা আমার দারোয়ানের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম।‘ এরপরে ছবিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায় । কিন্তু সমস্যা হয় ছবির জন্য হল বুক করে রাখা ছিল । তাই প্রমথেশ মাত্র আটদিনে একটি ছবি নির্মাণ করেন । ফিউচারিস্টি কছবিটির নাম ছিল ‘বেঙ্গল ১৯৮৩’ । ১৯৩২ সালে ছবিটি হাতিবাগানের একটি প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ হয় । সেই হলের নাম স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ‘রূপবাণী’ । প্রমথেশের সঙ্গে সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বিভূতি দাস, সুশীল মজুমদার প্রমুখেরা । ছবিটি বাণিজ্য সফল হয়নি ।
‘অপরাধী’ এবং ‘বেঙ্গল ১৯৮৩’ তৈরি হওয়ার সময়কালের মধ্যেই বড়ুয়া ফিল্মসের নাম পালটে বড়ুয়া পিকচার্স প্রাইভেট লিমিটেড করা হয় । প্রমথেশের অনুরোধে ধীরেন গাঙ্গুলি বড়ুয়া ফিল্মসে যোগ দেন । প্রমথেশ নিজে বম্বে, গয়া, বেনারস ঘুরে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেন । ইতিমধ্যে টকি এসে গেছে । ডিজি’র সঙ্গে প্রমথেশ ‘অনাথ’ বলে একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেন । কিন্তু প্রমথেশ শিল্পী ছিলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল তাঁর আয়ত্ত্বাধীন হলেও এর ব্যবসায়িক দিকটি সম্বন্ধে তাঁর অনভিজ্ঞতার কারণে অচিরেই বড়ুয়া পিকচার্স প্রাইভেট লিমিটেড উঠে যায় । প্রমথেশ প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েন । বড়ুয়া ফিল্মসের জন্য প্রমথেশকে পিতা প্রভাতচন্দ্র প্রথম দিকে অকুন্ঠ সাহায্য করেছিলেন । এ বিষয়ে তিনি রাজবাড়ির বিশ্বস্ত দেওয়ান দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ( কবি অমিয় চক্রবর্তীর পিতা ) ‘র পরামর্শ পর্যন্ত গ্রাহ্য করেননি । কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধরাজাও একসময় পুত্রের অবিমৃশ্যকারিতায় বিরক্ত হয়ে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে প্রমথেশ স্টুডিও বিক্রি করে দেন।
এই সময়েই প্রমথের জীবনে দুটি এমন ঘটনা ঘটে যার ফলে প্রমথেশের জীবনের বাঁক বদলে যায়।
( ক্রমশঃ)
অনিন্দ্য গৌতম পেশায় পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের একজন আধিকারিক। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় উপশাসক এবং উপসমাহর্তা পদে কর্মরত। মূলত অন্তর্জালে লেখালেখি করেন।
Comment here