‘ গায়কি তৈরি হয় প্রতিটি শিল্পীর প্রকাশভঙ্গির নকশা অনুযায়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার আগে বুঝে নিতে হবে তাঁর টেম্পারমেন্ট বা মেজাজ।আর সেই মেজাজ অনুযায়ী কোন শ্রুতিতে কতটা দাঁড়াতে হবে কোন পর্দা ছুঁয়েই চলে যেতে হবে এসব খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ন্ত্রণ, এই দুটি বস্তুর সমন্বয়েই গায়কী গড়ে ওঠে।অন্যভাবে বলা যায়, সৌন্দর্যচেতনাটাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবচেয়ে বড় কথা।এই বোধ জন্মালে গায়কী আপনা হতেই গড়ে ওঠে।এই বোধটা যার সহজাত অবশ্যই পারে সে ফুল ফোটাতে’।
বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রীমতী সন্ধ্যা সেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কথাকটি বলেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহ। তিনি পেরেছিলেন ফুল ফোটাতে।এক স্বতন্ত্র গায়কী নিয়ে পরিশীলিত উচ্চারণ ও দরদী উপস্থাপনার মাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিস্তীর্ণ ভুবনে হয়ে উঠেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত শিল্পী।
শ্রী নির্মলচন্দ্র গুহঠাকুরতা ছিলেন বরিশালের সুযোগ্য সন্তান।তাঁরই জ্যেষ্ঠা কন্যা ঋতুর জন্ম হয় ১৯৪০ এর ২৪ মার্চ।কাকা ছিলেন শুভ গুহঠাকুরতা।এই দুই ভাই- ই ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমিক।শচীন দেব বর্মণ,ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়।অনুপম ঘটক,কে.এল. সায়গল প্রমুখের নিত্য আসা যাওয়া ছিলো গুহঠাকুরতা পরিবারে।বাড়ি ভরা ছিলো নানাধরনের গানের রেকর্ডে।সুতরাং সেখানেই ছোটোবেলাতে গানের প্রতি ভালোবাসা শুরু।
গান শিখতে ঋতু গুহঠাকুরতা শুরু করলেন শুভ গুহঠাকুরতা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণীতে। দক্ষিণীর সূত্রপাত ১৯৪৮ সালে। শুভ গুহঠাকুরতা তো ছিলেনই তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী শ্রীমতী মঞ্জুলা গুহঠাকুরতা,শ্রী সুনীল রায় প্রমুখ।বলা যায় এই দক্ষিণীই ঋতুর জীবনে একটি বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে।দক্ষিণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখবার পাশাপাশি দক্ষিণীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিভাগ খোলা হলো।নাম হলো গীতভানু।সেখানে একই সঙ্গে ঋতুর ক্লাসিকাল গান শেখা শুরু হলো।১৯৫৩ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সর্বপ্রথম গান করলেন। গানদুটি ছিলো ‘ এ মোহ আবরণ’ এবং ‘ ভুল কোরো না গো’। ১৯৬১ সাল।রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ।সেই বছরই মেগাফোন কোম্পানী থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম গানের রেকর্ড। গানদুটি ছিলো ‘ বাজো রে বাঁশরি’ এবং ‘ আজি এ নিরালা কুঞ্জে’।
এই সময়েই কলকাতার ব্যস্ত চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট শ্রী শচীন্দ্রনাথ গুহর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী বুদ্ধদেব গুহ এলেন ঋতুর জীবনে। দক্ষিণীতে গান শেখবার সময় পরিচয় দুজনের।সেই পরিচয় পূর্ণতা পেলো প্রেমে।প্রেম যাঁর সাহিত্যে স্বর্গীয় পারিজাতের সুবাস নিয়ে উপস্থিত হয় তিনি নিজের প্রেম নিয়ে লিখবেন না তা তো হয় না।শ্রী বুদ্ধদেব গুহ তাঁর বহু রচনায় তরুণী ঋতু গুহঠাকুরতার প্রতি তাঁর প্রথম ভালোলাগা ব্যক্ত করেছেন।একটা অংশ তুলে ধরি, ” ওর এক জ্যাঠতুতো বোন ছিল ও থিয়েটার টিয়েটার করতো আমার সঙ্গে।ফোন করেছে – বুদ্ধদেবদা ঋতুদির লাইভ প্রোগ্রাম আছে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে,আপনিও ওখানে আসবেন তাহলে দেখা হবে।তখন লাইভ ব্রডকাস্ট হত আর বসবার ঘরে একটা সেট থাকত।তা গাইল ‘ কাঙাল আমারে কাঙাল , ‘ আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’ আরেকটা কি গান।তারপর গীতবিতানটা হাতের মধ্যে ধরে এসে দাঁড়িয়ে বলল- আমি এসেছি।দ্যাট ওয়াজ দি কামিং, শি কেম ইনটু মাই লাইফ”।
না সংখ্যার দিক থেকে বলতে গেলে খুব বেশী গান রেকর্ড করেন নি ঋতু গুহ।কিন্তু যে কটি গান রেকর্ড করেছেন প্রত্যেকটি গান যেন ঋতুগুহর গান হয়েই আমাদের কাছে রয়ে গিয়েছেন।তাঁর রেকর্ড করে যাওয়া যে কটি গান আজও রসিক শ্রোতার কানে অমৃতধারা সিঞ্চন করে তার মধ্যে রয়েছে ‘ বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’,’ চিরস)খা হে ছেড়ো না’,এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ,’ ‘ কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে’,শ্রাবণের ধারার মত’ ‘ বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে’,’ওগো সুন্দর আজি’,’ আমারে যে বাঁধবে ধরে’, ”আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি’,’ ধনে জনে আছি জড়ায়ে’,’ আজি এই গন্ধবিধূর সমীরণে’,’ ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার’,’ বাজিল কাহার বীণা’,ইত্যাদি।
রবীন্দ্রগীতিনাট্য বাল্মীকি প্রতিভার যে লং প্লেয়িং রেকর্ড প্রকাশিত হয় সেখানে ঋতু গুহ অংশ নিয়েছিলেন।নিজে খুব ভালো পিয়ানো ও অর্গ্যান বাজাতে পারতেন তবে অনুষ্ঠানে সাধারণতঃ তানপুরার সঙ্গে গান গাইতে ছিলেন স্বচ্ছন্দ।বিদেশে বেশ কয়েকবার সঙ্গীত পরিবেশন করতে গিয়েছেন ঋতু গুহ।মুগ্ধ করেছেন সেখানকার শ্রোতাদের।
পল কক্স পরিচালিত ‘ আইল্যান্ড’ নামক ইংরিজি ছবিতে ‘ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ গানখানি গেয়েছিলেন তিনি।খুব বেশী অনুষ্ঠানে গাইতে চাইতেন না।টিভির পর্দায় নিজেকে দেখানো ছিলো ঘোর অপছন্দের।
সদাব্যস্ত ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী স্বামী বুদ্ধদেব গুহ যাতে নিজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করতে পারেন তার জন্য তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী।দুই কৃতী কন্যা মালিনী ও সোহিনীকে বড়ো করেছেন।নিজের সুন্দর রুচি ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে সামলেছেন সবকিছু। বারংবার শ্রোতারা শুনতে চেয়েছেন তাঁর গান।কিন্তু জনসমক্ষে গান শোনাতে খুব বেশী আগ্রহী ছিলেন না তিনি।দক্ষিণীতে একসময় গান শিখিয়েছেন,নির্বাচিত কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে স্পেশাল ক্লাস নিয়েছেন বাড়িতেও।
মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। চোখের সমস্যাও ছিলো।বাইরের দুনিয়া থেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে।২০১১ র ২৪ ডিসেম্বর যখন সারা কলকাতা খ্রিস্টমাস ইভের তোড়জোড়ে ব্যস্ত তখন বড়ো নীরবে চিরবিদায় নিলেন ঋতু গুহ।দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত সানি টাওয়ার্সের সাজানো ফ্ল্যাট,সাজানো সংসার,একটা একটা করে কেনা শখের সব জিনিস- সবকিছু ফেলে রেখে ঋতু গুহ হলেন অমৃতধামের যাত্রী। চন্দন কাঠের চিতাশয্যায় পঞ্চভূতে লীন হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের অনন্যা গায়িকা ঋতু গুহ।
সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক শ্রী অলক রায়চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন,” ঋতুর উচ্চারণ ক্রমশঃ আমারই হয়ে যাচ্ছে ‘ হেরো মম প্রাণ যৌবন নব করপুটতলে পড়ে আছে তব’। এমন নিরাভরণ স্বগতোক্তি শুনলে গানে গড়া স্বপ্নের রংগুলো ক্রমশঃ গাঢ় হতে থাকে।আদত রং দুটিই কেবল।সাদা আর কালো।সেই কালো আর ধলোকে ভেষজ রঙিন করে রেখে গেছেন ঋতু তাঁর গানে।নিজেকে জাহির করেননি।অন্তরঙ্গে অন্তরে তিনি।এমনই থাকবেন”।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here