২০১৯ সালের ৩সেপ্টেম্বর কলকাতার শিশির মঞ্চে টেগোর সোসাইটি অফ কলকাতার উদ্যোগে বেশ কয়েকবছর ধরে গুরুতর অসুস্থ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পূর্বা দামের চিকিৎসার সাহায্যার্থে একটি সঙ্গীতসন্ধ্যার আয়োজন করে।সুসাহিত্যিক ও সঙ্গীত শিল্পী এবং পূর্বা দামের স্বামী অরুণ দামের সহপাঠী শ্রী বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন সেই সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ।সেটিই ছিলো শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব গুহর শেষ মঞ্চানুষ্ঠান।সেদিন শিশিরমঞ্চ ছিলো পরিপূর্ণ।সকলেই সেদিন শ্রীমতী পূর্বা দামের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন।
এর পরের বছর ২০২০ র ১৯ সেপ্টেম্বর চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন পূর্বা দাম।ঘটনাচক্রে সেদিন ছিলো তাঁর গুরু সুচিত্রা মিত্রর জন্মদিন।
পূর্বা দাম বিয়ের আগে ছিলেন পূর্বা সিনহা।তাঁর মামা ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র।ছোটোবেলা থেকেই ছিলো তাঁর গানের প্রতি আকর্ষণ। বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে শুনে তাঁর কান তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।৬-৭বছর বয়স অবধি তিনি ময়মনসিংহে ছিলেন। তারপর তিনি কলকাতআয় আসেন।কলকাতায় আসবার পর যখন ১৯৪৫ সালে সুচিত্রা মিত্রর গাওয়া ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’ গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হলো তখন সেই গান শুনে তিনি ঠিক করলেন যে সুচিত্রা মিত্রর কাছে গান শিখবেন।পূর্বা সিনহার কাকা তরুণ সিনহা ছিলেন সুচিত্রা মিত্রের পরিচিত। তরুণ সিনহা থাকতেন যতীন দাস রোডে।সেখানে সুচিত্রা মিত্র এসে কিশোরী পূর্বাকে গান শেখাতেন।এরপর সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান রবিতীর্থে গান শিখতে শুরু করলেন নিয়মিত ভাবে। পাশাপাশি বেঙ্গল মিউজিক কলেজে ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়,নির্মল মুখোপাধ্যায়,প্রমুখের কাছেও গান শেখা চললো।মালবিকা কাননের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে রজনীকান্ত,দ্বিজেন্দ্রগীতি ও অতুলপ্রসাদের গানের তালিম নেওয়া শুরু হলো পূর্বার।কিন্তু এর পরে তিনি পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে।
সুচিত্রা মিত্র অনেক যত্ন করে নিজের মনের মতো করে তৈরী করলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ এই ছাত্রীটিকে।যে কোনও অনুষ্ঠানে পূর্বাকে গান গাইবার অনুমতি তিনি দেননি।প্রথম সবার সামনে তিনি গাইলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এক রবীন্দ্রজন্মোৎসবের পুণ্যদিনে। এরপর ১৯৬২ সালে আকাশবাণীতে প্রথম গান গাইলেন পূর্বা। ১৯৬৫ সালে গ্রামাফোন কোম্পানী থেকে প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হলো।এর কয়েক বছরের মধ্যেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কৃতী ছাত্র অরুণ দামের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন পূর্বা সিনহা।বিবাহোত্তর জীবনে রেকর্ড করা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করা চলতে লাগলো নিয়মিত।তবে পূর্বা দাম সব অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন না। যেখানে প্রকৃত বোদ্ধা শ্রোতারা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে আসেন সেখানেই তিনি গান শোনাতেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি সুচিত্রা মিত্রর ধারার উত্তরসূরী কিন্তু কোনওদিন সুচিত্রা মিত্রকে অনুকরণ করেন নি।স্বতন্ত্র এক গায়নভঙ্গীমা ও পরিবেশনরীতিকে সঙ্গী করে পূর্বা দাম শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।সঠিক উচ্চারণ,স্বরলিপির প্রতি নিষ্ঠা এবং দরাজ কন্ঠ এই ত্র্যহস্পর্শ ঘটেছিলো পূর্বা দামের কন্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীতে। রবীন্দ্রনাথের সুর ও কথার মেলবন্ধনে এক অনন্য শিল্পীর আর একনাম তাই পূর্বা দাম।
কোনও কোনও গান তাই অনায়াসেই পূর্বা দামের গান হয়ে থেকে যায়।’ ঐ আসনতলে মাটির পরে’,’ হেথা যে গান গাইতে আসা’,’ আমারে তুমি অশেষ করেছো’,’ সে যে পাশে এসে বসেছিলো’,’ সন্ধ্যা হল গো ও মা ‘,’ আমারে তুমি অশেষ করেছো’,’গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি’,’ না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে’,’ রাত্রি এসে যেথায় মেশে’,’ শ্রান্ত কেন হে পান্থ’ ইত্যাদি গানগুলি শ্রোতারা বারংবার তাঁর কাছে বারংবার শুনতে চাইতেন। …সামনে থেকে বহুবার তাঁর গান শোনবার সুযোগ হয়েছে আমার।সামান্য যন্ত্রানুষঙ্গে হারমোনিয়ামের সামনে স্থিতধী পূর্বা চোখ বুজে একের পর এক গান গেয়ে চলতেন।শুধু শিল্পী নন সাধিকার মতো তিনি যেন নিজের কন্ঠ দিয়ে সঙ্গীতের পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করতেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের চরণপ্রান্তে।
শেষ জীবনে খুব ভালো ছিলেন না পূর্বা দাম।নানাধরনের ব্যাধিতে জর্জরিত ছিলেন।গাইতে পারতেন না।করতে পারতেন না অনুষ্ঠান।স্মৃতিভ্রংশতা গ্রাস করেছিলো তাঁকে।তারপর তো বড়ো নীরবে চলেই গেলেন।কোভিড আক্রান্ত কলকাতার অগণিত রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমী শেষসময়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন নি পূর্বা দামকে।তিনি নেই কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁর গান।রবীন্দ্রনাথের গান যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের কাছে তাই পূর্বা দাম থেকে যাবেন চিরকাল।
– পেশাগতভাবে সরকারী কর্মী, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েই বাঁচেন, লেখলেখির মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত।
Comment here