শাশ্বত সনাতন

-: বাঙ্গালার শৈবধারা :-

(পূর্বের অংশের পর)

(দ্বিতীয় অধ্যায়)

 

– শ্রী সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

ওঁ জগতপ্রভু রুদ্রনাথ ভৈরবেশ্বরায় নমঃ
সকলকে “মহাশিবরাত্রি”র আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই
ভগবান মহেশ্বর এর কৃপা বর্ষিত হোক সকলের ওপর

গতবছর এই পূণ্যতিথিতেই মহাদেব এর অশেষ কৃপায় বাঙ্গালার শৈবধারা সংক্রান্ত আমার একটি লেখা ‘কাঞ্জিক’ এ প্রকাশিত হয়েছিল। জগদীশ্বর এর আশীর্বাদে সেই লেখারই পরবর্তী ভাগ নিয়ে উপস্থিত হলাম|

 

🔴 বাঙ্গালার শৈব সিদ্ধান্তিক ধারা:-

শৈব সিদ্ধান্তিক বা শৈবাগমপন্থী আচার্যদের এক বৃহৎ পীঠ ছিল বঙ্গভূমি। দেবকোট/কোটিবর্ষ অর্থাৎ আজকের বানগড় অঞ্চলে ত্রয়োদশ শতাব্দী অবধি এখানে আচার্যদের সাধনা ও বাসস্থান ছিল বলে জানা যায়। শৈব সিদ্ধান্তিক আচার্যগণ সমাজে উচ্চ সম্মানিত ছিলেন এবং পাল সম্রাটদের রাজগুরু পদ ও অলঙ্কৃত করেছেন।

বাঙ্গালার শৈব সিদ্ধান্তিক আচার্যদের উৎপত্তি মহামুনি দুর্বাসা থেকে। মত্তময়ূর নামে পরিচিত এই শৈবাগমপন্থী আচার্য যাঁরা প্রাচীন মন্ত্রমার্গিক সৈদ্ধান্তিক শৈবধারা অবলম্বন করতেন তাঁদের কথা ত্রিকা এবং সৈদ্ধান্তিক বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়। মহামুনি দুর্বাসা সমস্ত শৈব আগমের আদি জ্ঞানী ছিলেন, তিনি আমার্দক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাঁচজন ঋষিকে বিভিন্ন আগম তথা তন্ত্রের দীক্ষা দেন। এই ঋষিদের পন্থায় দীক্ষিত ব্রহ্মসূত্রের প্রাচীনতম ভাষ্যকার শৈবাচার্য সনাতন গৌড়ক্ষেত্রে দেবকোটে শৈবাগমপন্থী সৈদ্ধান্তিক মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে সৈদ্ধান্তিক এবং পাশুপত ধারা একত্রিত হয়ে যায়।

উল্লিখিত মঠের আচার্যগণ নামের শেষে শিব বা শম্ভু ব্যবহার করতেন। শৈবাচার্য প্রভাবশিব বা সদ্ভাবশম্ভু এই মঠের আচার্য পদে উন্নীত হন। বাঙ্গালার শৈবাগমপন্থী এই মঠে আচার্য বিশ্বেশ্বরশিব, আচার্য শান্তশিব প্রমুখ আচার্যগণ ছিলেন। আচার্য জ্ঞানশম্ভু জ্ঞানরত্নাবলী এবং শিবপূজাৎসব গ্রন্থের লেখক, আচার্য ত্রিলোচনশিব সিদ্ধান্তষড়বলী গ্রন্থের লেখক, আচার্য বরুণশিব বরুণিয়াপদ্ধতি গ্রন্থের লেখক, আচার্য ঈশানশিব তন্ত্রপদ্ধতি বা ইশানপদ্ধতি গ্রন্থের লেখক প্রমুখ প্রখ্যাত শৈবাচার্যগণ এই মঠের ছিলেন।

ষষ্ঠ সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক যিনি নিজেও পাশুপত শৈব এবং শৈব সিদ্ধান্ত অনুগামী ছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর সমগ্র বঙ্গভূমি জুড়ে রাজনৈতিক অশান্তি এবং মাৎস্যন্যায় এর প্রভাব শৈব মঠের ওপরও পড়ে এবং শৈব সিদ্ধান্ত এর বিস্তার ম্লান হয়ে পড়ে। এর পর এই অবস্থা থেকে পাল সাম্রাজ্যের শাসনকালে শৈব সিদ্ধান্ত ধারার পুনরুদ্ধার করেন আচার্য বিদ্যাশিব।

আচার্য বিদ্যাশিব দশম-একাদশ শতাব্দীর মানুষ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শৈব গ্রন্থ এবং ত্রিকা শৈব গ্রন্থ থেকে তাঁর সম্বন্ধে জানা যায়। আচার্য বিদ্যাশিব এর পর তাঁর শিষ্য আচার্য ধর্মশিব বাণগড় মঠের আচার্য পদে আসীন হন। ধর্মশিব একসময় বারাণসীতে বসবাস করতেন এবং সম্ভবত গৌড়েশ্বর মহীপাল এর বারাণসী জয়ের সময় তাঁর সঙ্গে পরিচিতি হয়। আচার্য ধর্মশিব এর পরবর্তী আচার্য ছিলেন আচার্য ইন্দ্রশিব। আচার্য ইন্দ্রশিব এর নিকট গৌড়েশ্বর মহীপাল দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্য একটি কৈলাশের ন্যায় মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মঠ প্রস্তুতিতে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ ব্যবহার হয় এবং এর মধ্যে বহু মন্দির ও দীঘি ছিল। আচার্য সর্বশিব যিনি ইন্দ্রশিব এর পর আচার্য হন তিনি ছিলেন গৌড়েশ্বর নয়পাল ও গৌড়েশ্বর তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজগুরু। আচার্য সর্বশিব এর পর প্রখ্যাত আচার্য মূর্তিশিব আচার্য পদে উন্নীত হন। আচার্য মুর্তিশিব সর্বশিব এর ভ্রাতা ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। মূর্তিশিব জৈন দিগম্বরদের শাস্ত্রাঘাত এ পরাজিত করেন এবং তাঁর জ্ঞান ভৃগু ও প্রভাকরের অধিক ছিল বলা হয়েছে বাণগড় প্রশস্তিতে। বাণগড় প্রশস্তি আচার্য মূর্তিশিব এর সুহৃদ আচার্য রূপশিব লিখেছিলেন। এঁদের ছাড়াও আচার্য বক্ত্রশিব নামক এক শৈব সৈদ্ধান্তিক এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

 

 

🔴 দক্ষিণ ভারতে বাঙ্গালী শৈব আচার্য:-

দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত শৈব সৈদ্ধান্তিক ছিলেন আচার্য অঘোরশিব। তিনি বহু বহু শৈব গ্রন্থ রচনা করেন যার মধ্যে শৈব সাধনা আরাধনা পদ্ধতির বিষয়ে লিখে গেছেন। তাঁর প্রদর্শিত পথেই দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ স্থানে শৈব সৈদ্ধান্তিক পদ্ধতিতে কাজকর্ম হয়ে থাকে। আচার্য অঘোরশিব এর জন্ম গৌড়দেশে বলে একটি সূত্র থেকে জানা যায়। এছাড়াও অঘোরশিব এর দুই গুরু আচার্য সর্বাত্মশম্ভু এবং আচার্য পরমেশ্বর পূর্বোল্লিখিত বাঙ্গালার সৈদ্ধান্তিক মঠের আচার্য পদে ছিলেন।

বাঙ্গালা থেকে দক্ষিণ ভারতে আরও বহু শৈব আচার্য গিয়েছেন বলে জানা যায়। তামিলনাড়ু অঞ্চলে শৈব আগম শিক্ষার জন্য আচার্য যেতেন বাঙ্গালা থেকে।এমনকি চোল সাম্রাজ্যেও গৌড় থেকে যাওয়া আচার্য স্কন্দশিব, আচার্য ভবশিব, আচার্য আনন্দশিব রাজগুরু পদে ছিলেন।

 

🔴 বাঙ্গালার শৈবমঠ:-

বাঙ্গালার সর্বপ্রধান শৈবমঠ ছিল কোটিবর্ষ শৈব সৈদ্ধান্তিক মঠ। অধুনা বানগড় অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত গোলগি বা গোলাকি মঠ বহিরাগত ইসলামী আক্রমণের আগে অবধি সমগ্র ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিল। এই মঠের আচার্যদের সম্বন্ধে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। মূল মঠ ছাড়াও এই অঞ্চলে পাল সম্রাটদের প্রতিষ্ঠিত আরও ছোট বড় বহু মঠ ও মন্দির ছিল। জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বাংলার বাইরেও বানগড় মঠ সুখ্যাতি অর্জন করেছিল বলে কথিত আছে।

 

গৌড়েশ্বর নয়পাল এর সিয়ান শিলালিপি থেকে জানা যায় ঐ অঞ্চলে ত্রিপুরারি অর্থাৎ মহাদেবের একটি মন্দির এবং তৎসংলগ্ন একটি দ্বিতল মঠ নির্মাণ করেন। তামিল লেখনী থেকে জানা যায় অধুনা পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলেও শৈবদের একটি মঠ ছিল যেখানে দক্ষিণ ভারত থেকে শাস্ত্রচর্চার জন্য আসতেন সকলে।

ষোড়শ শতাব্দীতে দক্ষিণ রাঢ়ের ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যে রায়মুখূটি বংশের শাসনকালে কাটশাঁকড়া শিবমন্দিরের নিকট একটি শৈবমঠ ছিল বলে জানা যায়। এই মঠের সন্ন্যাসীরা সকলেই দক্ষ মল্লযোদ্ধা ছিলেন এবং ভুরশুট রাজ্যের প্রান্তে প্রহরী রূপেও কাজ করতেন। পাঠান ওসমান খান মহারাজা রুদ্রনারায়ণ এর মৃত্যুর পর ভবশঙ্করী দেবীকে আক্রমণ করলে ছদ্মবেশী মুসলমান সৈনিকদের এই মল্ল সন্ন্যাসীরা পথেই আটকে দেন এবং তাদের মেরে দামোদরের খালে ভাসিয়ে দেন।

প্রখ্যাত শৈব ক্ষেত্র মহানাদ এ প্রাচীন জটেশ্বরনাথ মন্দিরের নিকট একটি নাথপন্থী মঠ ছিল বলে জানা যায়। ত্রিবেণী থেকে কিছুদূরে অবস্থিত এই মঠে নাথপন্থী আচার্য ও সাধকগণ থাকতেন, এনারা সাধারণ মানুষের মধ্যে যুগী বা যোগী বলে পরিচিত ছিলেন। পূণ্যভূমি মহানাদ বহুকাল ধরে শৈব সন্ন্যাসী বিশেষত নাথপন্থীদের বিচরণ ক্ষেত্র বলে প্রসিদ্ধ। এখানে বশিষ্টগঙ্গা নামক জলাশয় ছিল। এই মঠে উপস্থিত শিষ্যদের মধ্যে থেকে পরবর্তী মোহন্ত নির্বাচনের রীতি ছিল।

 

হুগলির তারকেশ্বর ও গুপ্তিপাড়ায় দশনামী সম্প্রদায়ের শৈব সন্ন্যাসীদের মঠ ছিল। মূল তারকেশ্বর ছাড়াও হাওড়া হুগলির বৈদ্যবাটী গড়ভবানীপুর সন্তোষপুর প্রমুখ বহু জায়গায় দশনামী মঠ নির্মিত হয়েছিল। এইসমস্ত মঠ ছিল তারকেশ্বরের মহন্তের অধীনে। এছাড়াও প্রাচীন শৈব ক্ষেত্র মুর্শিদাবাদেও বেশ কিছু শৈবমঠের উপস্থিতির কথা জানা যায়।

 

🔴 বাঙ্গালী জীবনে শৈব প্রভাব:-

ইশ্বরের আশীর্বাদধন্য বঙ্গভূমিতে প্রভু মহাদেবের বহু প্রাচীন মন্দির যেমন রয়েছে তেমনি প্রায় প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে তাঁর সাধনালয় উপস্থিত, তিনি বঙ্গের অন্যতম প্রসিদ্ধ দেবতা সেই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু বাঙ্গালার প্রাচীন শৈবধারার বহুলাংশে বিলুপ্তি হলেও তার প্রভাব কীভাবে বাঙ্গালী জীবনে রয়েছে সেই নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” আদতে নাথপন্থী সিদ্ধ সাধকদের দ্বারাই বহু শতাব্দী ধরে লিখিত। পা বা পাদ পদবীধারী এই সাধকরা নাথ সম্প্রদায়েরই অংশ এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে দোহা ছন্দে কবিতা লিখতেন যা চর্যাপদ নামে খ্যাত। ইতিহাসে বাঙ্গালী বা বঙ্গালী শব্দের প্রথম উল্লেখ ভুসুকুপাদ এর চর্যাপদ লেখনীতেই পাওয়া যায়।

 

 

বাঙ্গালায় সর্বাধিক প্রচলিত বঙ্গাব্দ বা শশাঙ্কাব্দ যা গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক কর্তৃক প্রণীত তা সৌর অব্দ এবং এর শৈব সংযোগ রয়েছে। শৈব শশাঙ্ক পাশুপত শৈবদের উৎসব চড়ক ও গাজনের তিনদিনব্যাপী উপাসনা ও উৎসবের পরের দিন থেকে এই অব্দ প্রচলন করেন। এছাড়াও গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন যিনি নিজেকে পরমশৈব বলে উল্লেখ করেছেন শিলালিপিতে, তিনি নিজ পুত্রের জন্মের থেকে লক্ষ্মণাব্দ প্রচলন করেছিলেন।

 

 

বাঙ্গালা থেকে শৈব আগম ও তন্ত্র অনেকাংশে বিলুপ্ত হলেও তা অনেকক্ষেত্রে বেঁচে রয়েছে শাক্ত আচারের মধ্যে। বাঙ্গালায় শাক্ত উপাসনা আদতে শৈব তান্ত্রিকদের হাত ধরেই শুরু।

পূর্বে উল্লিখিত আচার্য মুর্তিশিব এর বাণগড় প্রশস্তিতে আমরা দেবী চর্চিকা এর উল্লেখ পাই। দেবী চর্চিকা আদতে মা চামুণ্ডার নামান্তর মাত্র। এই প্রশস্তিতে দেবীকে বিশ্ব রক্ষার নিমিত্তে আবাহন করা হয়েছে। এই প্রশস্তিতে চর্চিকা স্তব সহ আরও মন্ত্র রয়েছে যেখানে দেবীকে অষ্ট মাতৃকার একজন ধরা হয়েছে। পালযুগের দেবী চর্চিকা ই রূপভেদ এ হয়ে উঠেছেন বঙ্গেশ্বরী মা কালী। এই প্রশস্তিতে আমরা এক শান্ত স্বভাবের দেবী ভবানীর উল্লেখ ও পাই। বাঙ্গালার প্রাচীনতম দুর্গাপূজাগুলিকে নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই এর মধ্যে অধিকাংশই গৌড়েশ্বর মহীপাল ও নয়পাল এর সময়েই শুরু। এই সময়েই শৈবাচার্যগণ রাজগুরু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

বাঙ্গালায় পাল সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে বা তার আগেও দেবী দুর্গার আরাধনা করা হতো শাবর মন্ত্র ও পদ্ধতিতে। এই শাবরতন্ত্র উদ্ভাবক নাথপন্থী সাধকরাই। বৌদ্ধ লেখায় উল্লিখিত খণ্ডাতিরতি বপ্যট ও পরবর্তীকালে তাঁর সুপুত্র গৌড়েশ্বর গোপাল এর দ্বারা পূজিত দেবী চুন্দা যে আদতে মা চণ্ডী বা দশভূজা দনুজমর্দিনী মা দুর্গা তা সহজেই বোঝা যায়। এই সমস্ত লেখনীতে উল্লিখিত পদ্ধতিও আদতে শাবর বা নাথপন্থী সাধকদের প্রদর্শিত পদ্ধতিই। এছাড়াও কালীঘাট এর মতো পবিত্রস্থল যে যোগী চৌরঙ্গীনাথের আদি সাধনক্ষেত্র তা প্রমাণিত সত্য। সুতরাং একথা সহজেই বলা যায় বাঙ্গালার বিপুল শাক্ত ধারার উৎস আদতে বাঙ্গালার শৈবধারার মধ্যেই নিহিত ছিল।

 

 

শৈব সন্ন্যাসীদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শস্ত্রচর্চা। নাথপন্থী দশনামী সকল সন্ন্যাসীরাই সর্বদা ত্রিশুল বা তলোয়ার জাতীয় অস্ত্রসহ থাকেন। এই সন্ন্যাসীরা সর্বদাই বহিরাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মাৎস্যন্যায় শেষ করার ক্ষেত্রে নাথপন্থী শৈব সন্ন্যাসীদের ভূমিকা ছিল। ভুরশুটের সন্ন্যাসীদের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বরেন্দ্রভূমিতে দশনামী সন্ন্যাসীরা পণ্ডিত ভবানী পাঠকের সাথে একত্রিত হয়ে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিলেন।

 

বাঙ্গালী জীবনে নাথপন্থার প্রভাব গভীরভাবে বর্তমান। সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন নাথ সম্প্রদায়ের মঠ এর উদ্ভব যে এই মাটি থেকেই তা আমাদের অত্যন্ত গর্বের বিষয়। গুরু দত্তাত্রেয় বাঙ্গালায় ত্রিনাথ নামে পরিচিত, তিনি অনেক ক্ষেত্রেই নাথ সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত বলা হয় এবং এই নামকরণ সেখান থেকেই। আমাদের সমাজে নাথ, দেবনাথ ইত্যাদি পদবী দেখা যায়। যোগী বা যুগী বলে পরিচিত নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা যারা আয়ুর্বেদ জাতীয় চিকিৎসা বিদ্যায় বিশারদ ছিলেন, তাঁদের অনেকেই সাধারণ সমাজে মিশে গেছেন। বাংলায় মহাবীর হনুমান ও ভৈরব এর প্রসিদ্ধির পিছনেও নাথযোগীরা রয়েছেন, এই দুই দেবতাই শাবরমন্ত্রে সহজেই তুষ্ট হন এবং বাঙ্গালার অনেক ব্যায়াম ও কুস্তির আখড়ায় শাবর স্তম্ভন মন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আজও মহাশিবরাত্রি, চড়ক গাজন এর মতো অনুষ্ঠানে বহু নাথপন্থী সন্ন্যাসী এসে ত্রিবেণী মহানাদ, চৌরঙ্গীধাম, গোরক্ষবাসী মন্দির প্রমুখ জায়গায় জড়ো হন। নাথপন্থী সন্ন্যাসীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকতেন, তাঁদের সাধনপদ্ধতির সাথে বৌদ্ধ সংমিশ্রণেই সহজিয়া পন্থা এবং পরবর্তীকালে বাউল পন্থার উদ্ভব হয়।

বাঙ্গালার শৈবধারার ইতিহাস বড়ই উপেক্ষিত। এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণামূলক কাজ খুব কম হয়েছে, যে সমস্ত কাজ হয়েছে তাও অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট এবং সেখানে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। এর মধ্যে থেকেই সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধান করে পরিবেশন করলাম। ভগবান শিবশম্ভুর পরম কৃপায় ও আশীর্বাদে এই লেখাটি লিখলাম, তিনিই মূল চালকশক্তি এই অধম কলম ধরেছিল মাত্র। লেখাটি পরমারাধ্য মহেশ্বর এর চরণে অর্পণ করলাম । ………………..ওঁ নমঃ শিবায়।।

 

তথ্যসূত্র:- 

  • Epigraphica Indica
  • Inscriptions of Bengal, NG Majumdaar
  • Corpus of Bengal Inscriptions, RR Mukherjee & SK Maity
  • Nāth Sampradāya. Brill’s Encyclopedia of Hinduism. Vol. 3, James Malinson
  • The Origin and Development of the Bengali Language, Suniti Kumar Chatterjee
  • Natha Cult and Mahanad: a study in syncretism, PK Bandyopadhyay
  • বাঙ্গালীর ইতিহাস, নিহাররঞ্জন রায়
  • সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সরকার
  • গৌড়লেখমালা, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
  • নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস দর্শন সাধনপ্রণালী, কল্যাণ মল্লিক
  • রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী ও ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য
  • মূর্তিশিবের বাণগড় প্রশস্তি ও পালবংশীয় রাজাদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগ, চেতনা মুখার্জী
  • হঠযোগ প্রদীপিকা, স্বামী স্বত্মারাম
  • চর্যাগীতি পদাবলী, সুকুমার সেন
  • হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীর কুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংষ্কৃতিস, বিনয় ঘোষ

বিশেষ ধন্যবাদ:- ইন্টারন্যাশনাল শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ

 

(লেখক পরিচিতি: পদার্থবিদ্যা স্নাতক, সঠিক ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী, শক্তিচর্চায় নিবেদিত এক বাঙ্গালী যুবক)

Comment here