বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্ম হিন্দু। ভারতবর্ষে বর্তমানে হিন্দুর সংখ্যা ১০০ কোটি, কিন্তু তাদের মধ্যে একতা নেই। নানা মতবাদ, নানা উপাসনা, নানা জাতি, উচ্চনীচ ভেদাভেদ,হিন্দুধর্মকে শত সহস্র ভাগে ভাগ করে রেখেছে। কেউ শিবের ভক্ত, কেউ রামের। কেউ গণেশের উপাসক, কেউ হনুমানের। কেউ শিখ, কেউ বৌদ্ধ, কেউ রামকৃষ্ণমিশনে দীক্ষিত, কেউ ভারতসেবাশ্রম সংঘের অনুসারী। কারো গুরু সত্য সাঁই, কারো গুরু বাবা রামরহিম। সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য দেবতা, অসংখ্য গুরু, অসংখ্য মতবাদ।
এর বাইরে আরো বিভাজন। কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র। সুদীর্ঘকাল বিদেশী- বিধর্মীরা হিন্দুজাতিকে শাসনের সুবিধার্থে জাতির ভিত্তিতে , সণ্প্রদায়ের ভিত্তিতে,বিভাজন সৃষ্টি করেছে। শুধু বিধর্মীরা নয় ; বিভাজন সৃষ্টি করেছে হিন্দুধর্মের মধ্যেই শাস্ত্রজ্ঞানহীণ , বিশেষ সুবিধাভোগী ব্রাহ্মণ বলে কথিত তথাকথিত উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ। অথচ প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র বেদসংহিতায় জাতিভেদের কোন উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগেও কোন জাতি বিভাগ ছিলনা। এর উৎপত্তি আরো আধুনিক যুগে, বেদসংহিতার জ্ঞান লুপ্ত হওয়ার পর। ১০০% বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও বেদসংহিতাকে মৃতশাস্ত্র আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লুপ্ত হয়ে গেছে সনাতন মতবাদ- বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ। ফলে পুরাতন দেবতার পূজা, বহুদেবতা পূজা, গুরুপূজার কারণে সৃষ্টি হয়েছে একই ধর্মের মধ্যে অসংখ্য ফাটল। তাই দেশ টুকরো হয়েছে। তাই এখন মাত্র ১৫ কোটি মুসলমান ১০০ কোটি হিন্দুকে ধমক দিয়ে বলতে পারে- আমরা আবার দেশটাকে ভাগ করতে চাই। আমরা চাইলে হিন্দুস্তান থেকে হিন্দুজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি।
কীসের জোরে বলে? কারণ হিন্দুধর্মে একতা নাই। মুসলিমদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য। তাদের ধর্ম মসজিদ ভিত্তিক। ভারতে মসজিদের সংখ্যা যত লাখই হোক, তাদের একটাই উপাস্য- আল্লাঽ। খ্রীশ্চানদেরও তাই; একজনই গড- খ্রীষ্ট। হিন্দুধর্মেই শুধু একটা গ্রামে দশটা মন্দির, বিশটা দেবতা। তার ওপর নানা গুরুর নানা মত। এভাবেই অনৈক্য হিন্দুধর্মকে ভিতর থেকে দীর্ণ- বিদীর্ণ করে দিয়েছে। এই দুর্বল হিন্দুজাতিকে আরো বিভাজিত করেছে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খী ক্ষমতালোভী কিছু রাজনীতিক। বিভাজনের প্রক্রিয়া বিদেশী শাসনেই শুরু হয়েছিল, তাকে বর্ধিত করেছে স্বাধীনতা উত্তর বিভেদের রাজনীতি। বিভেদকামীরা হিন্দুদের মধ্যে হরিজন, বহুজন, নমঃশূদ্র, দলিত, SC, ST, OBC ইত্যাদি আরো অসংখ্য ভাগে ভাগ করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আর যারা হিন্দুধর্মকে হিন্দুস্তানে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে , তারা হিন্দুধর্মের স্বরূপই জানে না। ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ৫৫০০ বৎসরের পুরাতন নামকে সম্বল করে হিন্দুত্বকে জাগানোর নিষ্ফল চেষ্টা করছে। এমনিতেই রাম নামের গ্রহণযোগ্যতা দক্ষিণ ভারতে নেই; পঃবঙ্গ সহ পূর্ব/ উঃপূঃ ভারতেও নেই। বলা যায়, রামনাম সমগ্র ভারতবর্ষকে এক করতে অপারগ। তাছাড়া ঈশ্বরের পূর্বতন নাম সর্বদাই পরিত্যজ্য। যদি ধর্মের নামে হিন্দুজাতিকে এক করতে হয়, তাহলে ঈশ্বরের বর্তমান নাম সর্বাগ্রে জানতে হবে। ১০০ কোটি হিন্দুর মধ্যেই সেই নাম প্রচার করতে হবে; যাতে ১০০ কোটি হিন্দুই সেই একটি নামে ঈশ্বরকে ডাকে, উপাসনা করে। তবেই ধর্মের মধ্যে একতা আসবে, হিন্দুধর্ম শক্তিশালী হবে।
লক্ষ্য করুন, ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ১৯১/২-৩-৪ ঋকে এই ঐক্যের বাণী খুব দৃপ্ত স্বরে ধ্বণিত হয়েছে —
সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জাননা উপাসতে ।।২
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্ ।
সমানং মন্ত্রমভি মন্ত্রয়ে বঃ মানেন বো হবিষা জু হোমি ।। ৩
সমানী ব আকূতিঃ সমানি হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্তু বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি ।।৪
অর্থাৎ, হে স্তবকর্তাগণ! তোমরা মিলিত হও, একত্রে স্তব উচ্চারণ কর, তোমাদের মন পরস্পর একমত হোক। পূর্বতন দেবতারা যেভাবে যজ্ঞভাগ গ্রহণ করতেন, অধুনাতন দেবতা ঠিক সেভাবেই উপাসিত হয়ে যজ্ঞভাগ গ্রহণ করছেন।২॥ এ সকল পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণ এক প্রকার হোক, এঁর সঙ্গে সমাগত হোন, এঁদের মন, চিত্ত সকলি এক প্রকার হোক। হে পুরোহিতগণ! আমি তোমাদের একই মন্ত্রে মন্ত্রিত করছি; তোমাদের সর্বসাধারণ দ্বারা হোম করছি।৩।। তোমাদের অভিপ্রায় এক হোক, অন্তঃকরণ এক হোক, তোমরা যেন সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে একমত হও।৪।।
এই অধুনাতন দেবতার নাম কী, যে নামে ১০০ কোটি হিন্দু এক সুরে তাঁর স্তব উচ্চারণ করবে? বেদসংহিতার সনাতন তত্ত্ব অনুসারে এখন ঈশ্বরের নাম ‘অজন ‘। ১৯৯৮ থেকে প্রভু অজন এর যুগ শুরু হয়েছে, চলবে আরো ৯৪০ বৎসর। এই ৯৪০ বৎসর ধরে অনিবার্য ভাবে হিন্দুজাতি ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে বিশ্বশাসন করবে। কিন্তু সেই শক্তি অর্জন করতে হলে সমগ্র হিন্দুজাতিকে যা যা করতে হবে :
(১) ধর্মের মধ্যে ঐক্য আনতে হবে। ধর্মাচরণ করতে হবে সংঘভিত্তিক।
(২) মন্দির,মিশন, আশ্রম, বারোয়ারী পূজা, গুরুদীক্ষা, গুরুপূজা, গৃহে ঠাকুরঘর করে পূজা, সব কঠোর ভাবে বন্ধ করতে হবে।
(৩) প্রতি ১০০০ জন হিন্দু পিছু একটি করে অজন সংঘ গড়ে তুলতে হবে।
(৪) অজনসংঘে আধ ঘণ্টার জন্য সকলের উপস্থিতি হবে বাধ্যতামূলক।
(৫) অজনসংঘে সকলেই পর্যায় ক্রমে প্রভু অজনের ধ্যান-যোগ অভ্যাস করবে। বেদ-গীতার জ্ঞানচর্চা শুনবে। তবে সবকিছুই করবে সমবেত ভাবে।
(৬) ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যা থাকলে তা সংঘের অভ্যন্তরে আলোচনার ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে সমাধান করবে।
(৭) রাজনৈতিক বিষয়ে ঐকমতের ক্ষেত্রে সংঘ নির্দেশিত ধর্মীয় ঐক্যকে সর্বদাই প্রাধান্য দিবে।
একটা কথা স্মরণ করাব, যতদিন হিন্দুজাতি সংঘভিত্তিক ( যেমন বৃষ্ণিসংঘ, বৌদ্ধসংঘ) ধর্মাচরণ করত, তারা ছিল বিশ্বে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে- সম্পদে-সামর্থে শ্রেষ্ঠতম। হিন্দুদের এই সনাতন পদ্ধতিটিকেই অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মে মসজিদ এবং খ্রীষ্টধর্মে চার্চভিত্তিক উপাসনা রীতি গড়ে উঠেছিল। সুদীর্ঘকাল যাবৎ হিন্দুজাতি তার সনাতন রীতিটি বিস্মৃত হয়ে মন্দির, মিশন, বারোয়ারী পূজার মাধ্যমে ঈশ্বর উপাসনা করে চলেছে। নিজ নিজ গৃহের মধ্যে দেবতার মন্দির বানিয়ে হিন্দুসমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। গুরুদীক্ষা নিয়ে ঈশ্বর ত্যাগ করে মানুষ (গুরু) পূজায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে।
আবার ফিরিয়ে আনতে হবে হিন্দুধর্মে সংঘভিত্তিক ঈশ্বর উপাসনা। স্তব করতে হবে ঈশ্বরকে তাঁর বর্তমান নামে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এত লক্ষ সংঘ তৈরি বা চালানোর টাকা কোথা থেকে আসবে? ১০০ কোটি হিন্দুর জন্য বিপুল সংখ্যক সংঘের পরিচালন ব্যবস্থা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? সব উত্তর আছে। শুধু প্রয়োজন ‘ হিন্দুধর্মের ঐক্যের জন্য ‘ সমর্পিত কিছু দেশপ্রেমী মানুষ। সংঘভিত্তিক ধর্মাচরণ হলে হিন্দুজাতিও শক্তিশালী হবে; একই সাথে বহু লক্ষ( ১৫/২০ লক্ষ) মানুষের সংঘকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান হয়ে যাবে। অপরদিকে হাজার হাজার মন্দিরে, বারোয়ারী পূজায় হাজার হাজার কোটি টাকার অপব্যয় থেকে রক্ষা পাবে দেশ। কেউ আর মন্দির যাবে না, বারোয়ারী পূজা করবে না; গুরু উপাসনা করবে না। আশ্রম ও মিশনগুলিকে সম্পূর্ণ বর্জন করবে। বাড়ীতে ঠাকুরঘর করে ফুলনৈবেদ্য দিয়ে পূজা করবে না। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের একটাই মন্ত্র হবে :
ॐ অজনং শরণম্ কেবলম্।
ॐ অজনং সংঘং কেবলম্।
ॐ অজনং কৃপাহি কেবলম্ ।
শ্রী তপন আচার্য , শৈশবাবধি ঈশ্বরচেতনার সন্ধানে যুক্ত। হিন্দুধর্মের উপর মৌলিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত তাঁর কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ও পাঠকমহলের শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা অর্জন করেছে। 2015 সালে আমেরিকায় বিশ্বধর্মসম্মেলনে হিন্দুধর্মের বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।
Comment here