– Woke Hunter
ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টাদিনসবুরকর
রসুন বুনেছি।।
যারা সম্প্রতি মেওয়াতের দাঙ্গার খবরাখবর মোটামুটি ফলো করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই মনু মানেসর নামটা শুনে থাকবেন। স্থানীয় মুসলিম গুন্ডারা নিরপরাধ হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ গো-তস্করির সন্দেহে দুজন মুসলিম যুবকের হত্যায় অভিযুক্ত এই মনু মানেসরের মেওয়াতের শোভাযাত্রায় থাকার কথা ছিল। এই মনু মানেসর নাকি আসলে তোলাবাজ, তাঁকে হিন্দুবীর বানানো নিয়ে অনেক হিন্দু আপত্তি তুলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্থানীয় হিন্দু বাহুবলিরা তোলাবাজি করে, আবার শরণাপন্ন হিন্দুদের দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। এই কারণে অনেক বিরাট বুদ্ধিজীবি হিন্দুত্ববাদীরা “হিন্দু গুণ্ডাদের তোলাবাজি ভালো” এহেন কুতর্ক দিতেও পিছপা হন না। তা না হয় দিল।
কিন্তু এরা একধাপ এগিয়ে হিন্দুদের সঙ্গে যার তুলনা টানলো, তিনি হলেন অষ্টাদশ শতকের বাংলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ও ধনকুবের জগতশেঠ। জগতশেঠ? বাংলায় ফাটাকেষ্ট থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা থাকতে হঠাৎ জগতশেঠের উদাহরণ কেন? এই হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মতে, জগতশেঠ নবাব আলিবর্দি এবং পরবর্তীকালে ইংরেজদের আর্থিক সাহায্য করলেও কখনও হিন্দুবীর মারাঠা সৈন্যকে আর্থিক সাহায্য করেননি।
কিন্তু এত কথার মধ্যে যে সূক্ষ্ম মতলবটি লক্ষ্য করা যায়, সেটা হল বাংলায় মারাঠা আক্রমণএবং ১৭৪০-এর দশকে লাখ লাখ বাঙ্গালী হিন্দুর গণহত্যার লজ্জাজনক অধ্যায়টিকে কোনমতে ধামাচাপা দেওয়া কিংবা স্রেফ মিথ্যে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া। গণহত্যা অস্বীকারের এই কুপ্রবণতাকে ইংরেজিতে “Holocaust Denial” নামে ডাকা হয়। এমন কুপ্রচেষ্টা নতুন নয়, বরং গত কয়েক বছরে বহুবার লক্ষ্য করা গেছে, বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী ইউটিউব চ্যানেল বা টুইটার হ্যানডলের মাধ্যমে। সর্বভারতীয় হিন্দু ঐক্যের তাড়নায় বর্গি হামলাকে কম্যুনিস্টদের অপপ্রচার বলে ছলে বলে কোনমতে ধামাচাপা দেওয়া গেলেও বাঙ্গালীর সচক্ষে দেখা কলকাতার মারাঠা ডিচ আর শৈশবের ঘুমপাড়ানি গানের মধ্যে নিহিত অষ্টাদশ শতকের বাংলার করুণ গণহত্যার ইতিহাসকে কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়?
কোটি কোটি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে মারাঠা সাম্রাজ্যের ইতিহাস অসীম শ্রদ্ধা ও গৌরবের ইতিহাস, যাঁদের মধ্যে সনাতনী বাঙ্গালীরাও ও আছেন। অবশ্যই, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এবং তাঁর পুত্র ছত্রপতি সম্ভাজি মহারাজ হিন্দুদের উচ্চতম আদর্শদের অন্যতম, আমাদের সকলের প্রাতঃস্মরণীয় অনুপ্রেরণা। কিন্তু, শিবাজি মহারাজ আর মারাঠা সাম্রাজ্য কি সমার্থক? ছত্রপতির পরবর্তী প্রজন্ম কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছিল তাঁর আদর্শ?
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে মারাঠা সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল হিন্দু স্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। শিবাজি মহারাজ বুঝেছিলেন ভারতে বহিরাগত অত্যাচারী শাসনের অবসানের জন্য কেবল সামরিক আক্রমণ যথেষ্ট নয়, তার সাথে প্রয়োজন আর্থিক আগ্রাসন। যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান নীতি হল ইসলামে অবিশ্বাসী প্রজার উপর জাজিয়া কর আরোপ করে তাদের লাঞ্ছিত করা এবং আর্থিকভাবে দুর্বল করে রাখা। মারাঠারা এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চৌথ বা সারদেশ্মুখির নামে মুসলিম সুবাগুলির উপর করের ভারি বোঝা চাপাতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য ছিল, মাধ্যমে বিদেশি প্রাদেশিক সরকারগুলোকে হীনবল করে ফেলা যাতে সেই সব রাজ্যগুলোতে হিন্দু প্রজারা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেখানকার ক্ষমতা দখল করে নেয়। সীমাহীন লুণ্ঠন অথবা সংকীর্ণ মারাঠা বিস্তারবাদ নয়, হিন্দু গণমুক্তিই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর পুত্র ছত্রপতি সম্ভাজি মহারাজ, পৌত্র রাজারাম এবং তাঁর স্ত্রী তারাবাঈ হিন্দু স্বরাজের এই নীতিতে অবিচল থেকে এই সংগ্রামকে অব্যাহত রাখেন।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশতঃ ছন্দপতন হতে দেরি লাগলো না। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠা রাজনীতিতে উল্কার গতিতে ছত্রপতি সম্ভাজি মহারাজের আরেক পুত্র শাহুজির উদয় হল, যিনি এতদিন দিল্লিতে মুঘল সম্রাটের কাছে বন্দী ছিলেন।যার অক্লান্ত সংগ্রাম আর পরিশ্রমের বিনিময়ে রাজধানী রায়গড় মুঘলের কবল থেকে পুনরুদ্ধার করে মারাঠারা নর্মদা পার করে সুরাট আক্রমণ করার সাহস দেখিয়েছিল, সেই রানি তারাবাঈকে ক্রমাগত কোনঠাসা করা হল, কারণ তিনি ছিলেন আদর্শবাদী হিন্দু শাসক।যে হিন্দু স্বরাজের মহান আদর্শে শিবাজি মহারাজ তাঁর অনুগামীদের দীক্ষিত করে গিয়েছিলেন, ছত্রপতি শাহুজির কল্যাণে ক্রমশ সেই আদর্শ কালগর্ভে নিমজ্জিত হল। মারাঠা সাম্রাজ্য বাইরে থেকে স্বাধীন দেখতে লাগলেও, মুঘলদের সাথে সম্মুখ সমরের পন্থা ত্যাগ করে সমঝোতার পথে হাঁটা শুরু হল।ভারতের ইতিহাসে আরম্ভ হল, ক্রীড়নকমুঘল সম্রাটদের সস্নেহে সংরক্ষিত করে রেখে মুঘল আমলাতন্ত্রকে ঢাল বানিয়ে লুঠ ও নির্যাতনের কালো অধ্যায়।
অন্যদিকে, সুবে বাংলায় অনেক বড় ঝড় বয়ে গেছে। ঔরঙ্গজেবের একদা অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী মুর্শিদকুলি খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মারা গেলে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে দৌহিত্র সরফরাজ খাঁকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসানো হয়েছিল।কিন্তু, মাত্র এক বছরের মধ্যে তাঁকে ১৭৪০ সালের এপ্রিলে ভাগিরথীর তীরে সংঘঠিত গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত এবং হত্যা করে মুর্শিদকুলিরই বিশ্বস্ত তুর্কি বংশোদ্ভূত কর্মচারী আলিবর্দি খাঁ নিজে নবাবের সিংহাসনে আসীন হলেন। হীনবল মুঘল সম্রাটের জন্য এই ধৃষ্টতার কৈফেয়ত চাওয়া কল্পনার অতীত, তাই সঙ্গে সঙ্গে আলিবর্দি খাঁকে বাংলার নবাব ঘোষণা করে ফরমান বের করে ফেললেন।এতে যারপরনাই ক্ষেপে উঠলো বাংলা ও উড়িষ্যার সরফরাজপন্থী আধিকারিকরা বিশেষত সরফরাজ খাঁর শ্যালক ও উড়িষ্যার নায়েব নাজিম রুস্তম জঙ। আলিবর্দির বিরুদ্ধে রুস্তম জঙ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।উড়িষ্যার বালাসোরের কাছে ফলওয়াইয়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রুস্তম জঙ কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়ে আশ্রয় নিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছে। নিজামের মদতে রুস্তমের জামাতা মির্জা বাকর পুনরায় উড়িষ্যা দখলের প্রচেষ্টা করলে আবার পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
আলিবর্দির হাতে প্রতিবার লজ্জাজনক পরাজয়ে অধৈর্য হয়ে উঠলেন রুস্তম জঙ এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম। অবশেষে, এই দুই কট্টর মুসলিম যোদ্ধা বাংলা পুনরুদ্ধার করার একমাত্র উপায় হিসেবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিন্দু মারাঠা সাম্রাজ্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। রুস্তম জঙ আমন্ত্রণ জানালেন মারাঠাদের অন্যতম বিক্রমশালী নেতা, নাগপুরের জাগিরদার রঘুজি ভোঁসলেকে। সেই সময়ে রঘুজি ভোঁসলেই এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন যিনি ক্ষমতায় মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। মার্চ ১৭৪১এ ত্রিচনপল্লি বিজয়ের পর রঘুজি ভোঁসলে নাগপুর নিকটবর্তী বেরারে ফিরছিলেন, এমন সময়ে তাঁর কাছে রুস্তম জঙের দূতেরা দেখা করে, সাথে সামরিক মদতের আর্জি।রঘুজি অবিলম্বে তাঁর বিজয়ী সেনার পদাতিক সৈন্যদেরকে মির্জা বাকরের নেতৃত্বে উড়িষ্যায় পাঠান। মির্জা বাকরের ফৌজ উড়িষ্যা,মেদিনীপুর ও হিজলি পুনর্দখল করে আলীবর্দির জামাতা উড়িষ্যার নায়েব নাজিম সউলত জঙকে বন্দীবানায়। আলিবর্দি খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ কামান সমেত এক বিশাল সৈন্য মোতায়েন করেন উড়িষ্যায়।
এমন বিশাল নবাবি সৈন্য দেখে মির্জা বাকরের নেতৃত্বাধীন মারাঠারা সম্বল্পুরের জঙ্গলপথে প্রাণপণ নাগপুরে পালিয়ে যায়, যা শুনে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে নাগপুরের জাগিরদার রঘুজি। সুতরাং, প্রথম মারাঠা আক্রমণ ১৭৪২এ নয় ১৭৪১ হয়েছিল। এই প্রথম আক্রমণে পলায়নের লজ্জার শোধ তুলতেই বরংপরবর্তী আক্রমণের প্রয়োজন হয়।সবচেয়ে বড় কথা মারাঠাদের বাংলা আক্রমণের নেপথ্যে ছিল হায়দ্রাবাদের মুঘল অনুগত নিজামের উৎসাহ ও সমর্থন। নিজামের স্বার্থ, যাতে রঘুজী ভোঁসলের সমস্ত আগ্রাসী অভিযানের লক্ষ্য দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় এবং দাক্ষিণাত্যে নিজামের আসাফজাহি শাসনের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।
রঘুজী ত্রিচনপল্লি থেকে নাগপুরে ফেরার পর হায়দ্রাবাদের নিজাম ও ছত্রপতী সাহুজী মহারাজ দুজনের সঙ্গেই সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হতে থাকে। দীর্ঘ সামরিক অভিযানের পর ক্লান্ত রঘুজী নিজেও কোন নতুন অভিযানে বেরোতে প্রস্তুত ছিলেন না। সুতরাং, রঘুজী তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান ভাস্কর রামকোলহতকরকে বাংলা আক্রমণের দায়িত্ত্ব দেন। রঘুজীর এই কুখ্যাত চিতপাবন ব্রাহ্মণ কর্মচারী ইতিমধ্যে রায়পুরের কালচুরি সাম্রাজ্যে অভিযান চালিয়ে পুরো রতনপুর শহর লুঠ ও তছনছ করে। যাই হোক,অস্থির উড়িষ্যায় দীর্ঘ কয়েক মাস কাটিয়ে আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ ফিরছিলেন এমন সময়ে মেদিনীপুরের জয়গড় পৌঁছে খবর পেলেন ভাস্কর পণ্ডিত তেইশজন মারাঠা সর্দার(যার মধ্যেএকজন মুসলিম সরদারও ছিলেন, নাম সন্তান খাঁ) এবং প্রায় কুড়ি হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে মানভূম হয়ে পূর্বদিকে বর্ধমানের দিকে এগোচ্ছে।
উড়িষ্যা দিয়ে যাত্রার সময়ে ভাস্কর উড়িষ্যার পেশকার জানকীরামের ছেলে দুর্লভরামকে বন্দী বানায়। ১৫ই এপ্রিল, ১৭৪২এর দিন বর্ধমানে রানি দীঘির নিকটে মুখোমুখি হয় মারাঠা ও নবাবী সৈন্য। ভাস্কর শর্ত রাখেন দশ লাখ টাকা চৌথ হিসেবে দেওয়ার কিন্তু আলিবর্দি অস্বীকার করে। ব্রাহ্মণ ভাস্করের আদেশে আরম্ভ হয়, বর্ধমান জেলা জুড়ে মারাঠা বর্গিদের অত্যাচার, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা। সাধারণ মানুষ যাঁদের প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ হিন্দু, তাঁদের অনাহারে মৃত্যুবরণ করবার উপক্রম হয়।
প্রায় এক সপ্তাহ অবরুদ্ধ অবস্থায় রসদের অভাবে অতিষ্ঠ হয়ে আলিবর্দি অবরোধ ভেদ করে কাটোয়া হয়ে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার ছক কষে। হঠাত লক্ষ্য করলেন, মুস্তাফা খাঁ এবং অন্যান্য আফগান সেনাপতিরা বিদ্রোহ করছে, যুদ্ধ করতে অস্বীকার করছে। অগত্যা, আলিবর্দি বাধ্য হয় নাতি সিরাজকে সাথে নিয়ে মুস্তাফা খানের শিবিরে গিয়ে প্রাণভিক্ষা চাইতে।
এমন সময়ে, ভাস্কর পণ্ডিতের হাতে বন্দী হয় এক নবাবী কর্মচারী। নাম মীর হাবিব। মীর হাবিব ছিলেন সরফরাজপন্থী। সুযোগ বুঝে আনুগত্য বদলাতে সময় নিল না। পরবর্তীকালে, ভাস্কর ও রঘুজীর অদ্বিতীয় শুভাকাঙ্ক্ষী প্রমাণিত হবে মীর হাবিব। হয়ে উঠবে মারাঠা বর্গিদের মুখ্য উপদেষ্টা। নবাবী সৈন্য কাটোয়া পৌঁছনর পর হতোদ্যম ভাস্কর পণ্ডিত ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময়ে মীর হাবিব ভাস্করকে অরক্ষিত মুর্শিদাবাদে লুঠতরাজ চালাবার বুদ্ধি জোগায়। মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা সৈন্য ডাহা পাড়াঅঞ্চলে বাজার লুঠ ও অগ্নিসংযোগ করে। ভাগীরথী পার করে জগত শেঠ ফতেচাঁদের কুঠি থেকে লাখ তিনেক নগদ লুঠ করে। মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষ দলে দলে মালদা ও ভগবানগোলার দিকে পালাতে থাকে। মীর হাবিবের একান্ত উদ্যোগেই ভাস্করের মারাঠা সৈন্যের রাজধানী হয়ে ওঠে কাটোয়া।
মীর হাবিবের যোগ্য নেতৃত্বেই বর্গিরা দাঁইহাট, চন্দ্রকোণা, মেদিনীপুর প্রভৃতি পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় আধিপত্য স্থাপন করে এবং লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ছাড়াও অসহায় গ্রামবাসীদের হাত, নাক, কানকাটা প্রভৃতি অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি প্রভৃতি বিদেশি বণিকরা একে একে কাশিমবাজারে তাদের কারখানা খালি করে প্রাণরক্ষা করে পালাতে থাক।একদিকে ভাস্করকে বর্ষার ভয়ে বাংলা থেকে রণে ভঙ্গ দেওয়ার থেকে বারবার আটকানো, অন্যদিকে বিভিন্ন জমিদারদের সাথে শান্তি বার্তারও ব্যবস্থা করার কৃতিত্ব মীর হাবিবের। তথাকথিত হিন্দু রক্ষাকর্তা মারাঠারা তাঁদের এই মুসলিম শুভাকাঙ্ক্ষীর ঋণ শোধ করতে ভোলেনি। ১৭৫১ সালে উড়িষ্যা কার্যত বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর রঘুজি ভোঁসলে মীর হাবিবকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম পদে ভূষিত করা হয়।
ভাগীরথীর পশ্চিমকুল মারাঠা তাণ্ডবে নিঃশেষিত হওয়ার পর ভাস্করের লক্ষ্য পড়ে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সমৃদ্ধ জেলা হুগলীর উপর। কিন্তু, হুগলী জেলা দখল করা নেহাত সহজ কাজ নয়। হুগলী দখল করতে গেলে হুগলীর গড় দখল করতে হবে, যেখানে নবাবের ফৌজদার মহম্মদ রাজা খানের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এই কাজ স্থানীয় সহযোগিতা ছাড়া হবে না। এর জন্যেও মারাঠাদেরকে মীর হাবিবের শরণাপন্ন হতে হয়। কারণ মীর হাবিব স্বয়ং ছিলেন হুগলীর বাসিন্দা। জেলাটির নাড়ি নক্ষত্র তাঁর নখদর্পণে।মীর হাবিব বিলক্ষণ জানতেন হুগলীর ফৌজদার মহম্মদ রাজা লম্পট চরিত্রের। সারা রাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে, মদের নেশায় আর নাচের আসরে কেটে যায়। সাথে হুগলীর জাগিরদার ও মীর হাবিবের সৎ ভাই মোহম্মদ ইয়ার খাঁ। মীর হাবিব তাঁর বিশ্বস্ত দুই ফৌজদারি কর্মচারীর সাথে হুগলীর গড় দখলের পরিকল্পনা সেরে ফেলেন। অকস্মাৎ, এক রাতে মীর হাবিব মারাঠা সর্দার সিসরাওয়ের নেতৃত্বে প্রায় ২০০০ মারাঠা সৈন্য নিয়ে হুগলী গড়ের সিংহদ্বারে হাজির হলেন। ফৌজদার যথারীতি মহলের ভিতর আমোদ-প্রমোদে ব্যাস্ত। পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক ফৌজদারের কাছে খবর পাঠানো হয়, মীর হাবিব একা দেখা করতে এসেছেন। ফৌজদার নেশার ঘোরে সিপাইদের দরজা হাট করে দেওয়ার আদেশ দেন।
সকাল হতেই মারাঠা সর্দার সিসরাওকে হুগলীর জাগিরদার ঘোষণা করা হয়।হাবিবের বিশ্বস্ত কর্মচারী আবুল হাসানও ফৌজদার পদে ভূষিত হলেন। হুগলী আক্রমণের রাতেই হুগলীর বাসিন্দারা নিকটবর্তী চুঁচুড়া জেলায় ফরাসি এবং ওলন্দাজদের কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মারাঠাদে রকলকাতা আক্রমণের তীব্র সাধ থাকলেও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌসেনা সেই আশায় জল ঢেলে দেয়।
বর্ষাকালের প্রভাবে সম্মুখ যুদ্ধ থামলেও, থামলো না লুঠপাট, অরাজকতা, অগ্নি-সংযোগ, নারী-নির্যাতন ও গণহত্যা। কবি গঙ্গারামের লেখায় উঠে এসেছে রাঢ় বাংলার সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি, যা বিদেশি মুসলিম আক্রমণকারীদের বর্বরতাকেও হার মানায়। বর্ধমানের সভাপণ্ডিত বানেস্বর বিদ্যালঙ্কার থেকে শুরু করে মুসলিম ইতিহাসবিদ গুলাম হুসেন ও ইংরেজ কর্মচারী হলওয়েল, সবাই প্রায় কবি গঙ্গারামের বর্ণনার পুনরাবৃত্তি করেছেন। যে মারাঠাদেরকে প্রথমে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে বাংলায় হিন্দু শাসনের পুনরুদ্ধার ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার অবসানকারী রূপে আশা করা হয়, সেই মারাঠারাই নবাবেরই বিক্ষুব্ধ অনুচরদেরকে সাথে নিয়ে হয়ে ওঠে সমগ্র রাঢ় বঙ্গীয় হিন্দুদের ত্রাস।
বাংলার সনাতনী ছত্রিশ কুলের হিন্দু বাসিন্দারা চতুর্দিকে, যেদিকে দুই চোখ যায় সেইদিকে পালাতে মরিয়ে হয়ে ওঠে। রেয়াত পায়না ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবরাও। সকলেই নিজেদের শেষ সহায় সম্বল নিয়ে হন্যে হয়ে পালাচ্ছে,ব্রাহ্মণ বগলে পুঁথি নিয়ে, জেলে মাছ ধরার জাল নিয়ে,চাষা কৈবর্তরা ষাঁড়ের পিঠে, কাঁধে হাল বয়ে,কাঁসাই তামা-পিতল নিয়ে, কামার কুমোর চাকা নিয়ে, এ যেনএকাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতার বিভীষিকার পূর্ব-মহড়া ঘটে গেলো রাঢ় বঙ্গে। মাঝ রাস্তায় বর্গিরা উল্কাপাতের মত হাজির হয়, অসহায় আবাল বৃদ্ধ গ্রামবাসীদের চারদিকে ঘেরাও করে, সবলে ছিনিয়ে নেয় সমস্ত সোনা-রুপো। ধনসম্পদ শেষ হলেই, একে একে সকলের হাত, নাক, কান কেটে ফেলা অথবা পাশের কুয়োতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা। তার সাথে অবশ্যই, ছত্রপতি শিবাজির আদর্শকে সবেগে পদদলিত করে মুসলমানদের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অবর্ণনীয় নারী নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা। সবশেষে, গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ।বর্গি হামলা শেষ হয়ে গেলেও,মারাঠাদের হাতে বাঙ্গালিদের এই নিপীড়ন সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি। চুক্তির পর কাগজে-কলমে নবাবি সরকারের হাতে থাকলেও উড়িষ্যা বাস্তবে মারাঠা শাসনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে, উড়িষ্যা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্গত হওয়ার আগে অবধি,দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে মারাঠা হামলার বিচ্ছিন্ন ঘটনা লেগে থাকতো। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকে একবাক্যে বর্ণনা করতে গেলে ইতিহাসবিদ কালীকিঙ্কর দত্তের কথায়,”The Maratha incursions were perhaps the most calamitous events in the history of Bengal during the first half of the eighteenth century.”
মারাঠা বর্গিদের বর্বরতা থেকে বাংলার দেবদেবীদের বিগ্রহ পর্যন্ত রক্ষা পাননি। বর্ধমানের কয়রাপুরের দেবী ত্রৈলোক্য তারিণী, আড়ংঘাটার যুগলকিশোর, বর্ধমানের কাঁকোড়া ও মাঝিগ্রামের শাকম্ভরি দেবীর বিগ্রহ আজও মারাঠা নিগ্রহের চিহ্ন বহন করে আছে। জনশ্রুতি, নবদ্বীপের গৌরাঙ্গ পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া পুজিত ধামেশ্বর গৌরাঙ্গর নিমকাঠের শ্রীবিগ্রহখানিও বেশ কিছুকাল মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল বর্গি আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। এক সময়ে বর্গি বাহিনি মল্লভুমের রাজধানী বিষ্ণুপুর লুঠ করতে উদ্যত হয়েছিল।বর্গি যখন প্রায় দুর্গদুয়ারে উপস্থিত তখন অসহায় বিষ্ণুপুরবাসি প্রমাদ গুনছেন। জনপ্রিয় আখ্যান অনুযায়ী, এমন সময়ে নগরদেবতা মদনমোহন প্রকট হয়ে প্রকাণ্ড লোহার কামান তুলে নিয়ে বগলে চেপে ধরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হনএবংঅবশেষে বর্গিদের সর্বস্বান্ত করেন।এই ঘটনার উল্লেখ মদনমোহন বন্দনা গ্রন্থে পাওয়া যায়।
বাংলায় মারাঠাদের অরাজকতার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, এই আক্রমণের প্রতি বাংলার হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন ছিল? পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় মারাঠা শাসনে উভয় সম্প্রদায়ের অংশিদারীত্ব ঠিক কতটা ছিল?
আগে হিন্দু পক্ষকে দেখা যাক। নাগপুরের জাগিরদার ও তাঁর ব্রাহ্মণ দেওয়ানের এই পরিকল্পিত আক্রমণ ছত্রপতি সাহুজীর আদেশে করা হয়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। রঘুজী মুঘলদের সাথে সাহুজীর চৌথ আদায়ের বোঝাপড়া অনুযায়ী রঘুজী বাংলায় রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। সাম্রাজ্যের কর্ণধার হিসেবে সাহুজী কেবলমাত্র খাজনা আদায় ও চৌথের মাধ্যমে রাজস্ব উপার্জনে মনোযোগী ছিলেন, তাঁর পিতামহের মহতী হিন্দুবাদী আদর্শকে বহুকাল বিদায় জানানোর কারণে, বাংলায় হিন্দু নির্যাতন নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথা হওয়ার কারণ নেই।মুঘল সম্রাটের আদেশে মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশওয়া নানা সাহেব বালাজিরাও চৌথ ও খাজনার বিনিময়ে আলিবর্দি খাঁর পক্ষ থেকে রঘুজীকে দমন করলেও (যদিও তাঁর সৈন্য বিহার হয়ে বাংলায় প্রবেশের সময়ে কম লুঠতরাজ করেনি), ছত্রপতীর কঠোর নির্দেশে তিনি ভবিষ্যতে বাংলা মুখী হতে পারেননি (পেশওয়া ও রঘুজীর শত্রুতা নিয়ে খানিক পরে কথা বলা হবে)।
সুবে বাংলার অধিকাংশ জমিদার হিন্দু হলেও কেউই বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না আলিবর্দিকে নিয়ে। আলিবর্দি মুর্শিদকুলির দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে নিজে নবাব হন। এটা অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন না। সাথে জমিদারদের উপর খাজনা আদায়ের জন্য অনাবরত রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতেন। বিদ্রোহের সন্দেহে তাঁদের সামরিক শক্তিকে খর্ব করা হয়।নদীয়ার বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং অধুনা ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগের জনৈক হিন্দু জমিদার এই নবাবি অসহিষ্ণুতার শিকার হয়েছিলেন। বিদেশি বংশোদ্ভূত বিধর্মী শাসকদের হিন্দুধর্মের প্রতি ঘৃণা ও অপমানও এই হিন্দু জনসাধারণ ও জমিদারবর্গের ক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু, বর্গি হামলার প্রায় দশ বছরের ইতিহাসে বাঙালি বা অবাঙ্গালি বাসিন্দা, কোন রাজন্যবর্গই মারাঠাদের অরাজকতার সুযোগ নিতে এগিয়ে এলেন না।বাংলার সমস্ত অধিবাসী, রাজা প্রজা নির্বিশেষে হয় মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, নয় অত্যাচারের শিকার হলেন। বালাজিরাও আলিবর্দিকে রঘুজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করতে আসার সময়ে, সীতারামরায় নামের এক রাজপুত সর্দার তাঁকে রাজমহল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাংলায় প্রবেশের পথ দেখিয়ে দেন।হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার জমিদার তাঁর দুর্গের চার পাশ বড় পরিখা ও বাঁশের বেড়া দিয়ে দুর্গের চারপাশ ঘিরে দিলেন এবং প্রচুর সংখ্যায় মোতায়েন করলেন রক্ষী সিপাহীদের।
হুগলি জেলার ধনিয়াখালি থানার অন্তর্গত গ্রাম ভাসতারার জমিদার পরিবারের সদস্য শুকদেব সিংহ বর্গি আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বাড়ীর অন্দরমহলে তুলশী মন্দিরের কাছে নিহত হন। বর্ধমানের দেওয়ান মাণিকচন্দ্র সর্বক্ষণ অবিচলিত হয়ে নবাব আলীবর্দির সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বর্ধমান ও বিষ্ণুপুর এই দুই রাজ্য তাঁদের পুরনো বৈরিতা ভুলে বর্গিদের মোকাবিলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হন। মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা সৈন্যরা জগতশেঠের প্রাসাদ থেকে কয়েক লক্ষ টাকার সম্পত্তি লুঠ করে।মানকরায় ভাস্কর পণ্ডিত ও বাকি ২৩ জন মারাঠা সর্দারের হত্যায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন নবাবের বিশ্বস্ত হিন্দু কর্মচারী জানকীরাম। নিষ্ঠাবান হিন্দু দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ জানকীরাম ভাস্করের বিশ্বাস অর্জন করবার জন্য পবিত্র তুলসি ও গঙ্গাজল ছুঁয়ে মিথ্যে শপথ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। মারাঠাদের সাথে যুদ্ধের সময়ে জানকীরামের প্রশ্নাতীত আনুগত্যের জন্য আলিবর্দি তাঁকে পাটনার নায়েব সুবেদার পদে নিযুক্ত করেন, যে দায়ি জানকীরাম আমৃত্যু পালন করেছিলেন।
তাছাড়াও, দিনাজপুরের রাজা রামনাথ রায় দশটা কামান বসিয়েছিলেন বর্গিদের আটকাতে। শিখরভূমের রাজা গরুড় নারায়ণএর সামন্ত শেরগড় অধুনা আসানসোলের নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায় গোপভূমের রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের সাথে শেরগড়ের জঙ্গলে ভাস্করের সেনাপতি মোহনগিরিকে সম্মুখ যুদ্ধে হত্যা করেন, বৈদ্যনাথ নিজেও বীরগতি প্রাপ্ত হন। মল্লভূমের যুবরাজ কৃষ্ণসিংহ মল্ল অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে বর্গিদের আটকান, কিন্তু বিষাক্ত তীর লেগে পরবর্তীকালে মারা যান। দলমাদল চালিয়ে বর্গি দমন করাহয়। তাম্রলিপ্তের সেনাপতি মহাবীর চণ্ডভীম একটি শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেছিলেন, ওনার ভয়ে বর্গিরা আক্রমণই করেনি। মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ী আর নারায়ণগড়ের পাল রাজারা এইসময়ে ইংরেজ পক্ষেসাহায্য করেছিলেন মারাঠাদের বিপক্ষে।
অন্যান্য ছোটখাট জমিদারদের তখন তীব্র মানসিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবার উপক্রম হয়,একদিকে নবাবের ক্রমাগত খাজনার জন্য তাগাদা, অপরদিকে মারাঠাদের নির্মমতা ও লুণ্ঠন। সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে হয় ইংরেজদের আশ্রয়ে কলকাতা, চুঁচুড়ার ডাচ ও ফরাসি উপনিবেশ না হলে নবাবি শাসনাধীন পূর্ব ও উত্তর বাংলায় পালাচ্ছে।ওলন্দাজদের গণনা অনুযায়ী বাংলায় প্রায় চার লক্ষ মানুষ মারাঠাদের আক্রমণে নিহত হয়।এদের মধ্যে একটা বড় অংশ বিশিষ্ট ধনাঢ্য রাজা, জমিদার ও মহাজনেরা, যাঁদেরকে ছাড়া রাঢ় বাংলার অর্থনীতি আকেজো হয়ে যায়। বর্ধমানের সভাপণ্ডিত বানেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের কাব্য অনুসারে স্বয়ং বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন তাঁর রাজ্য থেকে কলকাতায় ইংরেজদের নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যান।
অন্যদিকে, বাংলায় মারাঠা আক্রমণে মুসলিম শাসকদের প্ররোচনার ভুরি ভুরি তথ্য প্রমাণ রয়েছে। মারাঠা আক্রমণ ঘটাতে সরফরাজের শ্যালক রুস্তম, তাঁর জামাই মির্জা বাকর এবং হায়দ্রাবাদের নিজামের যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল সেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়াও, এপ্রিল ১৭৪২এ ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্ধমানে যে তেইশ জন সর্দার উপস্থিত হন তাঁদের অন্যতম ছিলেন সন্তান খাঁ নামের এক মুসলিম। মীর হাবিবের অনস্বীকার্য ভুমিকাও সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। ১৭৫১ সালে যুদ্ধের অবসানের পর, মীর হাবিবকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত করে মারাঠারা। ১৭৪৪ সালে চতুর্থবারের জন্য রঘুজী এবং ভাস্করপণ্ডিতের সাথে যে তেইশ জন মারাঠা সেনাপতি বাংলা আক্রমণের জন্য উপস্থিত হন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আলি ভাইকরা ও আল এবং সহমত খাঁ ছিলেন অন্যতম। ভাস্কর পণ্ডিতের কাছে জানকীরাম ও মুস্তাফা খাঁ আলীবর্দির শান্তি বার্তা নিয়ে পৌঁছোবার পর এই আলিভাই করাওয়ালকেই মারাঠারা আলিবর্দির কাছে সন্ধির দৌত্যের জন্য পাঠায়।
পরবর্তীকালে, বিহারে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে আলীবর্দির অন্যতম প্রধান সেনাপতি আতাউল্লাহ খাঁ ও মীরজাফর খাঁ পাটনা আর মুর্শিদাবাদ দখলের উদ্দেশ্যে আলীবর্দির বিরুদ্ধে গোপনে বিশ্বাসঘাতকতার পরিকল্পনা শুরু করে। এমনকি, মেদিনীপুরে মারাঠা দমনের জন্য আলিবর্দি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নাতি সিরাজকে প্রেরণ করলে, সিরাজ পাটনা দখলের উদ্দেশ্যে কুচ করতে শুরু করে। এর মধ্যে কোন পরিকল্পনাই সফল হয়নি, কিন্তু এই কটা ঘটনা আলীবর্দির মত যে কোন বৃদ্ধ রণক্লান্ত ব্যক্তির মনোবল ভাঙ্গার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
১৭৪৫ সালে রঘুজী ভোঁসলের চতুর্থ বাংলা অভিযানের সময়ে,নবাবী সেনার অন্যতম প্রধান সেনাপতি, ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী মুস্তাফা খাঁ এবং আলীবর্দির অন্যান্য বিশ্বস্ত আফগান সেনাপতিরা মারাঠা শিবিরে যোগদান করলে, নবাবি শিবির বিরাট বড় ধাক্কা খায়।মূলত আফগানদের আহ্বানেই রঘুজী চোদ্দ হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় পুনরায় হাজির হয়েছিলেন। এরপর জানকীরামের পুত্র দুর্লভরামকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিমের পদে নিযুক্ত করা হলে, মারাঠারা তাঁকে পণবন্দী করে নাগপুরে নিয়ে যায়। জানকীরাম রঘুজীকে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ পাঠাবার পরই দুর্লভরামকে মারাঠারা মুক্ত করে।
এরপর, ১৯৪৫ সালের জুন মাসে আফগান বিদ্রোহীদের অধিনায়ক মুস্তাফা খাঁ নবাবি সৈন্যের দ্বারা নিহত হলে আফগানরা বিহারের সাসারাম জেলা সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে মারাঠা সৈন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।প্রায় কুড়ি হাজার আফগান ও মারাঠাদের মিলিত সৈন্য বাংলা ও বিহারে লুঠ ও সামরিক অভিযান চালাতে শুরু করে। রণনীতি অনুযায়ী আফগান বিদ্রোহীরা নবাবি ফৌজকে লড়াইয়ে ব্যস্ত করত, অন্যদিকে মারাঠা সৈন্য গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করতো। মুস্তাফা খাঁ যুদ্ধে নিহত হলে,মুস্তাফার পুত্র মোর্তাজা খাঁ এবং অন্যান্য আফগান সর্দাররা মারাঠাদের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
অবশেষে ১৭৫১ সালে মুর্শিদাবাদে নবাব মারাঠা চুক্তি হলে, মারাঠা পক্ষ থেকে মির্জা সালেহ নামের নাগপুরদর বারের এক মুসলিম সভাসদকে সেই চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য পাঠানো হয়। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে, রঘুজীর পুত্র জানোজি ভোঁসলে মীর হাবিবের হত্যা করালে, এই মির্জা সালেহকেই উড়িষ্যার নায়েব নাজিম বানায় মারাঠারা।
বর্গি হামলার ঘটনায় যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উঠে আসে তা হল নাগপুরের সর্দার এবং মারাঠা পেশওয়ার মধ্যে সাতারায় ছত্রপতির সভায় আধিপত্যের জন্য তীব্র সংঘাত, যা নানাসাহেব পেশওয়া অর্থাৎ বালাজিরাওয়ের পিতা বাজিরাওয়ের সময় থেকেই চলে আসছিল। এমন বলা হয় যে, নাসির জঙের সঙ্গে যুদ্ধের পর পেশওয়া বাজিরাও এবং তাঁর অগ্রজ চিমাজি আপ্পা মারা গেলে, রঘুজীকে প্রকাশ্যে উদযাপন করতে দেখা যায়, যা শুনে নানাসাহেব প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়।
মারাঠা সাম্রাজ্যের এই দ্বৈরথের কথা তৎকালীন মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে হায়দ্রাবাদের নিজাম সবারই জানা ছিল। ধূর্ত নিজাম এই সংঘাতের ফায়দা তোলেন। একদিকে তিনি দিল্লি ফেরার পথে নানাসাহেবের সঙ্গে বৈঠক করে অনাক্রমণের আশ্বাস দিয়ে তাঁকে উত্তর ভারতে চৌথ সংগ্রহ করতে বলেন, অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে যুদ্ধরত সর্দার রঘুজী ভোঁসলেকে বাংলার প্রাক্তন নবাব সরফরাজ খাঁর আত্মীয় রুস্তম খাঁর মাধ্যমে বাংলা আক্রমণের উৎসাহ দেন। রঘুজী ১৭৪৩ সালে তৃতীয়বার বাংলা আক্রমণ করলে মুঘল সম্রাট আলিবর্দির সহায়তার জন্য পেশওয়া বালাজিকে বাংলায় পাঠান। ৩১শে মার্চ, ১৭৪৩এর দিন পেশওয়া বালাজি পলাশির ময়দানে আলিবর্দির সাথে বৈঠক করেন এবং চৌথ, ২২লাখ টাকা মাল গুজারি এবং আরও হাতি, ঘোড়া উপহারের বিনিময়ে সামরিক সহায়তার আশ্বাস দেন। আলিবর্দি মারাঠা অশ্বারোহীর (light cavalry) সাথে এগিয়ে গিয়ে রঘুজীর পথ অবরোধ করেন এবং পেশওয়া পিছন থেকে পুনার ফৌজ এনে রঘুজীর সৈন্যকে পরাজিত করে। মেদিনীপুরে ভাস্কর পণ্ডিত তাঁর সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, পেশওয়ার পুনাবাহিনী নিয়ে আসার খবর শুনে তিনিও ঊর্ধ্বশ্বাসে বাংলা ত্যাগ করে নাগপুরে ফিরে যান। সাহুজি এই খবর পেয়ে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন এবং সাতারায় সভা ডেকে ফরমান জারি করেন, পেশওয়ার দায়িত্ব হবে মালোয়া, আগ্রা ও উত্তরভারতের অন্যত্র রাজ্যগুলোর থেকে চৌথ আদায় করা এবং রঘুজী বিহার, বাংলা এবংউড়িষ্যার দায়িত্বভার সামলাবেন।
সুতরাং, পেশওয়া বালাজির জন্য পরবর্তীকালে বাংলায় হস্তক্ষেপের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায়। সাহুজীও সব জেনে দুই পক্ষকে ব্যবহার করতেন সাম্রাজ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে। যদিও, সেই ভারসাম্য দীর্ঘদিন টেঁকেনি। বাংলা আক্রমণ অলাভজনক প্রমাণিত হয় এবং পেশওয়া নানাসাহেব মারাঠা সাম্রাজ্যে নিজের একাধিপত্য স্থাপন করেন। বাংলায় মারাঠা আক্রমণের কারণে মুর্শিদাবাদের নবাবি সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লো, এবংঅন্যদিকেপাল্লাদিয়েশক্তিশালীহতেথাকলব্রিটিশইস্টইন্ডিয়াকোম্পানি। বর্গি হামলায় দিশাহারা রাঢ় বাংলার অসহায় জনসাধারণকে ইংরেজরা কলকাতায় মুক্ত হস্তে আশ্রয় দিয়েছিল।
বর্তমানে যেটাকে আমরা সার্কুলার রোড হিসেবে চিনি,সেখানে বিরাট বড় খানা খোঁড়া হয় যার নাম মারাঠা ডিচ। এই ডিচ খনন করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্থিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। মারাঠারা হুগলীর গড় দখল করে নিলে, ইংরেজরা হুগলী নদীতে জাহাজ মোতায়েন করে কলকাতায় বর্গি আক্রমণ রুখে দেয়। বাঙালি দেখল,তাকে ব্যাবসা, বাণিজ্য, বহিরাগত বর্বরদের থেকে নিরাপত্তা এই সব কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আছে ইংরেজদের। যা এতদিন তুর্ক, মোগল, পাঠান করতে পারেনি, ইংরেজ মাত্র কিছু বছরে সেটা করে দেখালো। বৃদ্ধ আলিবর্দির
মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় নাতি সিরাজ মসনদে বসলো বটে। কিন্তু ,সিরাজের লাম্পট্য এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো উচ্চবিত্ত, জমিদার থেকে সাধারণ গ্রামবাসী সকলে।অতএব, সিরাজের মত অস্থিরমতি এবংঅসৎ শাসককে বাংলার মসনদ থেকে সরাতে ইংরেজ শাসনই ছিল বাংলার ললাট-লিখন।
তথ্য ঋণ স্বীকারঃ-
১) THE BENGAL EPISODE IN MARATHA HISTORY by T. S. Shejwalkar
২) Fall of Mughal Empire (Volume 1) by Sir Jadunath Sircar
৩) Alivardi And His Times by Kalikinkar Datta
৪)Land and Local Kingship in Eighteenth Century Bengal by John McLane R. CUP
৫) The Bansberia Raj by Shumbhoo Chunder Dey
৬) https://kanjik.net/bengals-aeonian-martialness-iv/
৭) https://youtu.be/e1BGvvwyvns?si=Y2Ic6uGCLG57ZzKR
৮)https://www.anandabazar.com/culture/book-reviews/review-of-a-book-written-by-swapan-kumar-thakur-1.1068702
৯)https://www.facebook.com/Halleysart/photos/a.4080874642004689/4080870182005135/?type=3&locale=sv_SE
১০) https://www.ebanglalibrary.com/180235/জানকিরাম-রায়/
১১) আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশেষ ধন্যবাদ আমাকে এই লেখায় সাহায্য করার জন্য।
(লেখক পরিচিতি: বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে MSc – Physics পাঠরত)