সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ – নীলিমা সেন

রবীন্দ্রনাথ তখন বেশ বৃদ্ধ।তাঁর জীবদ্দশায় শেষারের মত ‘ ডাকঘর’ মঞ্চস্থ হচ্ছে শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের অধিবাসী ললিতমোহন গুপ্ত ও পঙ্কজিনী গুপ্তের কন্যা নীলিমা বা বাচ্চু সেসময় একদিন সুযোগ পেল রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়ার।ডাকঘর নাটকে সে অমলের ভূমিকায় অভিনয় করবে। বালিকা বাচ্চু বিকেলবেলায় রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে তাঁর পাশে বসল।গুরুদেব তাঁকে বললেন, – দ্যাখ আমি তোর ঠাকুরদা হব।তোর তাতে কোনও আপত্তি নেই তো?

বালিকা বাচ্চুর কাছে এই কথা এক পরম প্রাপ্তি। রবীন্দ্রনাথ নামক পরশমণির পরশ পেয়েছে সে।আর কি চাই তার?

১৯২৮ সালের ২৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন নীলিমা।মাত্র ৬ বছর বয়সে নীলিমা শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন।তখন শান্তিনিকেতন রবিকিরণে উজ্জ্বল।একদিকে তাঁর স্বপ্নের বিশ্বভারতীতে চলছে নানা কর্মকান্ড। আচার্য নন্দলাল বসু,ক্ষিতিমোহন সেন,শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আপন কর্মকান্ডে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন।সেই পরিবেশেই নীলিমার বড় হয়ে ওঠা।নীলিমার বড় দিদি পারুলের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল ড. ধীরেন্দ্রমোহন সেনের।তিনি সপরিবারে এসে গুরুপল্লীর সীমান্তিকা বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন।সেসময় রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে বারংবার আসার সুযোগ হয়েছিল বালিকা নীলিমার।যখন নীলিমা পাঠভবনে ভর্তি হলেন তখন থেকেই আশ্রমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করেছিলেন। উদয়নের বারান্দায় কবি রবীন্দ্রনাথ বসে থাকতেন আর প্রতি বুধবার শান্তিনিকেতনের শিশুরা দল বেঁধে কবিকে প্রণাম করতে যেতো। কখনও শিউলি ফুলের মালা বা বেলফুলের মালা গেঁথে নীলিমা ও তার বন্ধুরা কবিগুরুকে দিয়ে আসতেন।

রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মদিনে উদয়ন বাড়ির বারান্দায় যে উৎসব পালিত হয়েছিল সেখানে মাত্র ১৩ বছরের কিশোরী নীলিমা একক গান গেয়েছিলেন ‘ গানের ঝরনাতলায়’।সঙ্গীতভবনে শিক্ষক হিসেবে নীলিমা পেয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে।এছাড়াও ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী,শান্তিদেব ঘোষ,রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে।ভি. ভি. ওয়াঝেলওয়ার দিয়েছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম। এস্রাজ শিক্ষা করেছিলেন অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।এইসময় নীলিমা চারবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বৃত্তিলাভ করেন একই সঙ্গে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হয়ে লন্ডন ব্রাহ্মসমাজ প্রদত্ত Tagore Hymn Prize পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৪৪ সাল।তখন নীলিমার বয়স ১৬ বছর।ভারত কোম্পানী থেকে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম রেকর্ড।একপিঠে ‘ বুঝি বেলা বহে যায়’ এবং অন্যপিঠে ‘ আমার দোসর যে জন ‘। এরপর নীলিমা একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করতে থাকেন এবং শ্রোতাদের মধ্যে তা প্রভূত জনপ্রিয় হয়।এই বছরই তিনি আকাশবাণীতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।১৯৪৫ সালে নীলিমা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন।১৯৪৬ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯৫০ সালে নীলিমা রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ড. অমিয়কুমার সেনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবন থেকে নীলিমা বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।সেই বছর স্বামীর সঙ্গে তিনি আমেরিকা যান এবং আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন।আমেরিকা থেকে ফেরবার সময় নীলিমা লন্ডন যান এবং লন্ডনে বিবিসি থেকে তাঁর গান প্রচারিত হয়।

১৯৫৭ সালে কলকাতায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নেতৃত্বে প্রসাদ সেন ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সুরঙ্গমা নামক রীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিকা হিসেবে নীলিমা সেন যুক্ত হন।১৯৬৪ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে যোগদান করেন নীলিমা।১৯৬৯ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন নীলিমা।১৯৭৭ সালে হন রিডার।১৯৮৪ সালে সঙ্গীত ভবনে সঙ্গীত ও নৃত্যবিভাগে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। পরবর্তীতে তিনি বিভাগীয় প্রধান ও পরে অধ্যক্ষাও হয়েছিলেন।সদস্য ছিলেন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডেরও।

আমেরিকা ও লন্ডন ছাড়াও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন শহরে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন নীলিমা।১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫ বছরে রাজশাহীতে রবীন্দ্রমেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে নীলিমা সেন আমন্ত্রিত হন।সেখানে বাংলাদেশের ছায়ানট ও অন্যান্য বহু সংস্থা দ্বারা বারংবার সংবর্ধিত হন নীলিমা।

সঙ্গীতের মত নৃত্যেও পারদর্শিনী ছিলেন নীলিমা।শান্তিনিকেতনে একসময় অনেকবার নৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।যখন গান গাইতেন তাঁর পরিবেশনা ছিল খুব সহজ।সন্তোষকুমার ঘোষ তাঁর গান সম্বন্ধে বলতেন যে তিনি গানকে সমর্পণ করতেন।তানপুরা ব্যবহার করতেন গানে।সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা আবু সয়ীদ আইয়ুব নীলিমা সেনের গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গিয়েছেন।তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা হয়তো খুব বেশী নয় কিন্তু ‘ হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল’,’ তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’,’ ‘ এ কি করুণা করুণাময়’,’ শুভ্র প্রভাতে পূর্ব গগনে’,’ মম দু:খের সাধন’,’ চিত্ত আমার হারালো’,’ও চাঁদ চোখের জলের লাগলো জোয়ার’ ইত্যাদি গানগুলির সঙ্গে নীলিমা সেন যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছেন।।রেকর্ডে চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে তাঁর গানও খুব সমাদৃত হয়।

১৯৯৩ সালে বিশ্বভারতী থেকে অবসর নেওয়ার কিছু পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তিনবছর পর ১৯৯৬ সালের ২৮ জুন জীবনাবসান হয়।

কঠোর পরিশ্রম,অন্তহীন সাধনা এবং অপরিসীম দরদ ও গানের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নীলিমা সেনের গায়কীতে প্রকটিত।তিনি আজও এক বরণীয়া শিল্পী হিসেবে আমাদের মনের মণিকোঠায় রয়েছেন।