অ্যালার্মের শব্দে ঘুমটা যখন ভাঙ্গলো, তখনও চারিদিকে নিকষ কালো আঁধার। হাত বাড়িয়ে জানালার ভারী পর্দাটা অতিকষ্টে একটু ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করলাম বাইরের পানে। দেখি সেখানেও চাপচাপ অন্ধকার। আশেপাশের বেড থেকে সিম্পল হারমোনিক মোশনে ভেসে আসছে নানান সুরে সানাইয়ের প্যাঁপোঁ-র সাথে মিশ্রিত সাইরেনের ভোঁ। হিসেব মতো এখনো মিনিট পনেরো আছে হাতে। সবার নাম ধরে এক এক করে হাঁক পাড়লাম। উত্তর এলো –প্যাঁ-পোঁ-ভোঁ। ধুর নিকুচি করেছে– এই ভেবে আরেকবার পর্দাটা একটু ফাঁক করে বাইরের পানে চোখ চালালাম। অন্ধকারটা একটু ফিকে হয়েছে বটে, তবে কেমন যেন ঘোলাটে। মনেরমধ্যেদুঃখেরমেঘগুলো আবার এসে দেখা দিল।
–“দাইনা তিরা তপাইলাই এভরেস্ট দেখিনছ। তেসকো সাথাই মা লোটসে আনি মাকালু। বাঁয়া তিরা দেখিনছ কাঞ্চনজঙ্ঘা র স্লিপিং বুদ্ধ।” সাধেই কি এতো কাঠখড় পুড়িয়ে হোটেলের এই ঘরখানা নেওয়া? হোটেল সানরাইজের এই ঘরটার এটাই বৈশিষ্ট্য। একপাশের জানালা দিয়ে দেখা যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট সহ এভারেস্ট পরিবারের আরও দুটি শৃঙ্গ মাকালু এবং লোটসে। সূর্যদেব যখন দিনের প্রথম যাত্রা শুরু করেন, সবার প্রথম ঘুম ভাঙ্গে এভারেস্ট পরিবারের। ডানদিকের জানালা দিয়ে সেই লুকোচুরির খেলা দেখতে দেখতেই সময় হয়ে যায় আদরের কাঞ্চনের ঘুম ভাঙ্গানোর। চোখ চলে যাবে বাঁদিকের জানালায়, যেখানে তখন ডানদিক থেকে এসে পড়া লালচে সোনালী আলোর আভায় শায়িত বুদ্ধের নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে ধীরে ধীরে। গোটাটাই আপনি উপভোগ করতে পারবেন বিছানায় কম্বলের তলা থেকে। সুখী আরামপ্রিয় বাঙ্গালীর জন্য এর চাইতে অধিক স্বর্গসুখ আর কোথায়?
কিন্তু এতো সুখ কপালে সইবে তো? যাত্রা শুরুর দিন থেকেই আকাশের মুখ ভার। গতকাল সূর্যোদয়ের বদলে কপালে জুটেছিল প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি। বাইরের ঘোলাটে ভাব দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আরেকবার পল্টনকে হুঁশিয়ারি দিলাম। ঘরের আলো তখনও জ্বালাইনি। ঐটি হল শেষ অস্ত্র। এদিকে রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ির কাঁটা তখন চারটে পার করে গেছে। অল্প অল্প ফর্সা হতে শুরু করেছে পুব দিক থুড়ি ডানদিক। আধো ঘুম থেকে জাগরণের পানে এগোচ্ছি আমিও। কিন্তু হায় রে কাঁচের বাইরে ঘোলা আকাশ! নির্ঘাত ঘন কুয়াশার আস্তরন বাইরে। এই আস্তরন ভেদ করে যদি বা কিছু দেখা যায় তবে তাঁর জন্য বাইরে বেরনো ছাড়া উপায় নাই। আচ্ছা, জানালা খুলে দেখবো কি? এই ভেবে জানালাটা হাতড়াতে লাগলাম। ছিটকিনি নাই! ভুলে গেছিলাম কোথায় আছি। বারো হাজার ফিট উচ্চতায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বিন্দুর কাছের একটি হোটেলের ঘরের জানালায় ছিটকিনি নামক বস্তুটি না থাকাই বাঞ্ছনীয়।
ছিটকিনি পেলাম না বটে, পেলাম অন্য একটা জিনিস। জানালার কাঁচটা কেমন জানি অমসৃণ। ডিজাইন করা ঘষা কাঁচের মত। ওঃহ! তাহলে তো বাইরে কুয়াশা নয়, জানালার কাঁচটাই অমন। কিন্তু পরমুহূর্তেই গা পিত্তি জ্বলে গেলো। আচ্ছা, এ কেমন আক্কেল? এরম ঘোলাটে ঘষা কাঁচের ভিতর দিয়ে সানরাইজ দেখবো কেমনে? আবার জানালা খোলারও উপায় নাই!সানরাইজ হোটেলের এ কেমন বুদ্ধি? তারা কি সত্যিই এমন নির্বোধ? আচ্ছা, তারাই কি এমন নির্বোধ, না… ভাবতে ভাবতেই ডানদিকের জানালায় সরু একফালি আবছা লাল দেখা দিল। এতোক্ষণে মনে হল যেন কুয়াশার জাল ছিঁড়ে মগজের ঘুমটা ভাঙ্গলো। নিজেকে একটা শেষ প্রশ্ন করলাম, কাল বিকেলবেলায় যখন হোটেলে এসে ঢুকলাম, তখন তো জানালার কাঁচ মসৃণ ছিল? বিদ্যুৎ খেলে গেলো সারা শরীরে আর সেই বিদ্যুতের গতিতে এক লাফে ঘরের আলোর সুইচটা টিপে পর্দাটা একটানে সরিয়ে দিলাম। কে যেন সারারাত ধরে বসে আল্পনা এঁকে দিয়ে গেছে গোটা জানালার কাঁচ জুড়ে। সূর্যোদয় আর কি দেখবো, সেই পাগল শিল্পীর সৃষ্টিই দেখতে থাকলাম হাঁ করে।
সম্বিত ফিরল পিছন থেকে খুক খুক আওয়াজে। একজন দুজন করে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠছে পথিকের দল। মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করে অতি সন্তর্পণে কাঁচের এক কোনায় অল্প একটু জায়গা করে নিয়ে মুখের দুপাশে দুহাত জড়ো করে কাঁচের উপর গরম ভাপ ফেললাম। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার… এইতো, এইতো গলেছে একটুখানি! আরেকটু, আরো একটু… তৈরি হল জানালার ভিতর এক টুকরোজানালা। দূরবীনে এক চোখ ঠেকানোর মত করে ঠেকিয়ে দেখতে পেলাম পুব দিগন্ত বরাবর একটা লাল রেখা শেষ রাতের কালচে নীল আকাশ আর নিচের ঘন কালো পাইন বনকেদুই ভাগে চিরে ছুটে চলেছে। আর তার উপরে, অনেক উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে, ভোর আকাশের শুকতারা।
– “কি রে? কি দেখিস?বাইরে তো কুয়াশা অন্ধকার!” পিছন থেকে ঘুম জড়ানো ডাক।
– “সূর্যদেবের রথ!”
আর তারপরই ছুট। ছুট ছুট ছুট! জামা জুতো চোগা চাপকান হাতের কাছে যা আছে তাই চাপিয়ে ছুট। পাগল শিল্পীকে হাতেনাতে ধরার এই তো সুযোগ। এক্ষুনিসে তারতুলির টান দিতে এসে পড়বে। এইবার আকাশের গায়ে।
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। উত্তরবঙ্গ জন্মভূমি এবং বর্তমানে কলকাতা কর্মভূমি। ভ্রমণপিপাসু এবং জ্ঞানপিপাসু।”
Comment here