সংস্কৃতি

কলমচিদের আড্ডাখানায় – ৪

(তৃতীয় পর্বের পর)

ছ’ নম্বর রাসেল স্ট্রিটের এই বাড়িটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রাজেশ্বরী দত্ত। সাহেবিয়ানা সম্পন্ন ফ্ল্যাটের বারান্দা আলো করে বসে থাকতেন সুধীন্দ্রনাথ।সাদা উর্দিপরা বেয়ারা রুপোর পেয়ালায় পরিবেশন করতেন চা।কখনো রাজেশ্বরী এগিয়ে দিতেন টুকটাক খাবার। যখন সুধীন্দ্রনাথ পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সে সময় পত্রিকার লেখক গোষ্ঠী বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। কখনো তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন। এভাবেই নিজস্ব বন্ধু-বান্ধবের গণ্ডি পেরিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমান জনপ্রিয়।

কালীঘাটের খালপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে যে বৈঠকখানা ছিল তাকে বলা হতো বাংলা সাহিত্যের কন্ট্রোলরুম। প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন নামের রাজা। প্রত্যেক সপ্তাহে তিনি দু -একজন সাহিত্যিকের বইএর নামকরণ করে দিতেন। একবার সাহিত্যিক শংকর তাঁর কাছে গিয়ে নিজের প্রথম বই এর নামকরণ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র শংকরের কাছে বইয়ের বিষয়বস্তু জেনে নিলেন তারপর বললেন, – তোমার বইয়ের নাম দাও ‘কত অজানারে’।ধন্য হলেন শংকর। ধন্য হলো বাংলা কথাসাহিত্য জগৎ।

গৌরি শংকর ভট্টাচার্য্য ছিলেন আলবার্ট হল এবং ইস্পাতের স্বাক্ষর এই দুটি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর বাড়ির শোওয়ার ঘর কাম বৈঠকখানা বাংলার বরেণ্য সাহিত্যিক দের কাছে ছিল অন্যতম আড্ডাস্থল। গৌরীশংকরের পাইকপাড়ার বাড়ির কাছেই থাকতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রায়ই এই বাড়িতে আসর বসাতেন।কখনো আসতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, প্রসিদ্ধ ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অবধূত। সকালবেলার আড্ডাধারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যুগান্তরের বার্তা সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন বসু, গৌরকিশোর ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রাজ্যেশ্বর মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ, শিবনারায়ণ রায় প্রমুখ। সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র খুব বেশি কথা বলতেন না যদিও বলতেন তাও খুব নিচু স্বরে। মাঝে মাঝে কালিপদ পাঠক গৌরীশংকরের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে আসতেন আড্ডা দিতে। টপ্পা গানের এই বরণীয় শিল্পীর গলার কাজ অন্যান্য আড্ডাধারীদের নাড়া দিয়ে যেতো।আড্ডায় আসতেন বিমল কর এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

কলেজ স্ট্রীটে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার ঘরে বসতো কলমবাজদের মজলিস। প্রথমেই বলে নেওয়া যাক এমসি সরকার সংস্থার আড্ডার কাহিনী।এই প্রকাশনা সংস্থা ছিল সে সময়কার অত্যন্ত অভিজাত দফতর।এই সংস্থার কর্ণধার সুধীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর আত্মজীবনীতে এই আড্ডার কথা অনেকাংশে বর্ণনা করেছেন। সাধারণতঃ বিকেলবেলায় আড্ডার আসর বসতো অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র প্রমূখ ছিলেন এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। মাঝে মাঝে আসতেন কেদার নাথ চট্টোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ভবানী মুখোপাধ্যায়। প্রমথনাথ বিশী এম সি সরকারের সাহিত্য আড্ডার নাম দেন হাউস অফ লর্ডস।

আর একটি আড্ডাকে প্রমথনাথ বলতেন হাউস অফ কমনস।কোন সে আড্ডা? সে গল্প পরের পর্বে।

 

(ক্রমশ)

Comments (1)

  1. […] (চতুর্থ পর্বের পর) […]

Comment here