চাষজমির ধূধূমাঠযুক্ত গ্রামের হাড়কাঁপানো শীত যখন তার সমস্ত রঙিন পার্বণের রেশে মাতোয়ারা করে একটু একটু করে প্রকৃতির কোলে বসন্তের ছোঁয়া জাগায় তখন আমরা সকলে আবারও মেতে উঠি নানান সংস্কারে, বসন্ত আবহে যেমন চাঁচরের পরেরদিন পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে রঙবেরঙের আবীরে দোল উৎসবে উদযাপন করি তারপরের পরই আসতে থাকে অতি অবহেলায় লুপ্তপ্রায় কিছু প্রথা।তেমনই হলো অধিদেবতা ঘন্টাকর্ণের পূজা।
“ঘেঁটু গাই ঘেঁটু গাই গেরস্থ বাড়ি,
এককাটা চাল দাও কুমড়োর বড়ি” -এমনই ছড়ার শব্দ শোনা যায় গ্রামবাংলার অলি-গলি-তস্যগলিতে, ফাল্গুন সংক্রান্তির ভোরে মাটির খোলায় (হাঁড়ি) গোবরের উপর প্রতি বাড়ির গৃহিণীগণের আনা হলুদ ছোপানো কাপড়টুকরো-কড়ি-চাল-ডাল-দক্ষিণা-সিঁদূর এবং ঘেঁটুফুল দিয়ে পুজো করে খোলা ছোট বাচ্চারা ভেঙে সূত্রপাত করে ঘেঁটুপুজো বা ঘন্টাকর্ণ পুজোর এবং সন্ধ্যাকালে কচিকাঁচারা সদলবলে কলাপেটো লন্ঠন-হ্যারিকেন আকারে তৈরী করে ঘেঁটুফুল সাজিয়ে থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি বের হয় উপহার স্বরূপ অর্থাৎ চাল-ডাল-আলু-লজেন্স-বিস্কিট সংগ্রহ করতে লোকগাথায় অধিদেবতা ঘন্টাকর্ণ বা ঘেঁটুঠাকুর আমাদের চর্মরোগ হতে রক্ষা করেন, তাই তাঁকে তুষ্ট করতে ফাগুন সংক্রান্তি বা ঘেঁটু-সংক্রান্তীতে ঘেঁটুপুজোর ক্রমশ ম্লান ঐতিহ্য বর্তমান
#ঘেঁটুপুজো শৈশবের বড় আপন এ দিন।
এভাবেই লোকাচারে কতশত দেবতা-অধিদেবতার পুজো রইতে গিয়েও হারিয়ে যায়। মাটিমাখা প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার লোকশিল্পের চিরপরিচিত এবং বর্তমান ম্রিয়মাণ প্রথা বহুরুপী।। নিম্নবিত্ত পরিবারের রুজিরোজগারও বলা যায় এহেন শিল্প প্রথাকে। রকমারি রঙ্ দিয়ে ভারতীয় বিশেষত বাঙালি দেবদেবীগণের কল্পিত রুপ নিজঅঙ্গে অঙ্কিত করে কাঁধে ঝোলা নিয়ে কাকভোরে ট্রেনবাসে সওয়ারী হয়ে রওনা দেয় ভিনগাঁয়ে-ভিনপ্রান্তের অলিতে গলিতে দুটো রোজগারের আশায়! কখনও নিজঅঙ্গে সজ্জিত দেবদেবীর মূর্তি অনুযায়ী নানান স্তব জনগণকে শুনিয়ে, কখনও সেই দেবদেবীর মাহাত্ম্য কথা, মাহাত্ম্য গান গেয়ে রাস্তায় বা বাড়ি বাড়ি মানুষকে বিনোদন দিয়ে ঝোলায় সংগ্রহ করে কিছু চাল বা দু’এক টাকা।। কিঞ্চিৎ সাদাসিধে মানুষ শিল্পীদের দেবতাজ্ঞানে তাঁর পায়ে জল দিয়ে ধুয়ে প্রণাম করেন আবার জল-বাতাসাযোগে মিষ্টিমুখ ও করান।। সারাবছর এই প্রথার প্রচলন রইলেও চৈত্র বৈশাখ মাসে অধিকাংশ চোখে পড়ে।। সারাদিন নানান জায়গায় নানান বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে চৈত্র বৈশাখের অগ্নিস্নানে গলদঘর্ম হয়ে অস্তমিত সূর্যকে সাক্ষী রেখে ঝোলায় সামান্য কয়েক মুঠো চাল আর কয়েকটা কয়েন সাথে অনেকখানি ক্লান্তি-হতাশা-পেটেক্ষিদে নিয়ে নিজস্থানে নিজ আস্তানায় ফিরে আসে বহুরুপী শিল্পীগণ।। কদরের অভাবে লুপ্তপ্রায় হয়ে চলেছে সাথে অভাব অনটনের শিকার হয়ে শিল্পীরা বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছেন রোজগারের ভিন্নপথ।।
বসন্তের বিদায়লগ্নে চৈত্রের তপ্ততায় কিয়ৎক্ষণ চোখজুড়ানো মনভোলানোর পরিতৃপ্তিতে পান্তাভাতে সিদ্ধ আলু আর বাঙালিয়ানার আকন্ঠ আস্বাদ নিতে চিরপরিচিত তেল লঙ্কার মিশেল উদরপূর্তি করতে আমরা সকলেই শুধু বাহানা খুঁজি কোনো অরন্ধন দিনযাপনের তাতে লেজুড় যেকোনো পুজো-লোকাচার মায় গ্রীষ্মের খরতাপ ২৪শে চৈত্র তাই পাঁচঘরা গ্রামে আজন্ম পরিচিত হয়ে চলে আসছে এই দিন #মাশীতলাও মণসা মাতার বার্ষিক পূজা। রাতভোর থেকে পদব্রজে পূণ্যতোয়া গঙ্গানদীর বারিপূর্ণ ঘড়া বহন করা থেকে শুরু করে দিনভর পুজোর আমেজ সাথে নানান আচার-মানতপুজো এবং বঙ্গজীবনের একনিষ্ঠ অঙ্গ পান্তাভাত । কালের ফেরে আমরা ১০০ বছরের এই ঐতিহ্য কখনই গ্রামের বাসিন্দা হয়ে ম্লান হতে দিইনি আশা রাখি অবসান হবে না।
এর মাঝেই সারা চৈত্রমাস জুড়ে চলে সন্ন্যাস নেওয়ার লোকাচার, সেটা কেমন? সারামাস জুড়ে বা মাসের কিছুদিন গৃহস্থ যেকোন মানুষ ইচ্ছা রাখেন পরিবারের মঙ্গলকামনায় সম্পূর্ণ গৃহজীবন ত্যাগ করে অথচ গৃহে আলাদাভাবে ব্রক্ষ্মচর্য পালন করবেন- পালঙ্ক বর্জন করে, একাহারী হয়ে, একসিদ্ধ অন্ন মাটির পাত্রে গ্রহণ করে, শুধুই একটি ধুতি পরিধান করে (মহিলা হলে ধুতিকেই শাড়ির ন্যায় পরিধান করে) দিনযাপন করেন এবং চৈত্রসংক্রান্তির সময় নিকটবর্তি অঞ্চলের শিবালয়ে গাজন উৎসবে সামিল হয়ে সন্ন্যাসীবেশ সমাপ্ত করেন। এহেন সন্ন্যাসীগণের একত্রীকরণে পালিত হয় শিবের গাজন। এবং সেইসাথেই বাংলার বহুলপরিচিত “ঝাঁপ ও চড়কপূজা” সম্পন্ন হয়। এই ঝাঁপ ও চড়কপূজা চৈত্রের শেষ দিনে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম কয়েকদিন ব্যাপি এই উৎসব চলে।
নানান পুরাণে চৈত্রমাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পুজোর কিন্তু কোনও উল্লেখ নেই। তবে জনশ্রুতি অনুসারে বহুবছর আগে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। রাজপরিবারের লোকজন এই পুজো করলেও, চড়ক পুজো কখনোই রাজরাজাদের পুজো ছিলনা। এটি ছিল মূলত হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি। পুজোর সন্ন্যাসীরা সবাই কথিত হিন্দুধর্মের নীচু সম্প্রদায়ের লোক। এই পুজোয় এখনও কোনও ব্রাক্ষণের প্রয়োজন পড়েনা। এই পুজোর অপর নাম নীলপুজো, শিবের গাজন এই পুজোরই রকমফের।
চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষদিন এই পুজো সম্পন্ন হয়। তার আগে চরক গাছকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্র শিবলিঙ্গের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়। পুজারীদের কাছে বুড়োশিব নামে পরিচিত।
এই পুজোর মূলে রয়েছে ভূত প্রেত, পুণর্জন্মের ওপর। পুজোর উদ্যক্তারা কয়েকজনের দল মিলে সারা অঞ্চল ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব, দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে ঘুঙুর এবং সাথে ঢোল, কাঁসর সহ বাদকদল। এরা বাড়ি বাড়ি যায় এবং গাজনের নাচ ও গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই পুজো হয়।
এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। চড়ক গাছের সাথে বিশেষ পদ্ধতিতে বাণ দিয়ে বড়শি দ্বারা সন্ন্যাসীদের ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাণবিদ্ধ সন্ন্যাসীরা ঝুলতে থাকেন।
রাতে নীলপুজোর পর সন্ন্যাসীরা উপোস থাকেন। পরদিন বিকেলে চড়ক পুজো শেষে সবাই নদীতে স্নান করতে যান। ফেরার সময় কলসি ভরে জল আনেন এবং চড়ক গাছের গোড়ায় জড়ো হন। তখন শিব পাঁচালি পাঠ করতে থাকেন পাঁচালি পাঠক। সন্ন্যাসীরা গাছের গোড়ায় জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাঁদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর চড়ক গাছে বিদ্ধ করে শূন্যে ঝুলতে থাকেন।
সংক্রান্তির আগের দিন রাত বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে ভয়ানক সব কাজকর্ম করতে দেখা যায় প্রেতসিদ্ধ সাধকদের। প্রেত আবাহন থেকে শুরু করে তাঁদের উপযুক্ত আহারাদি বন্দোবস্ত করে আরও ক্ষমতাসীন হওয়ার বাসনায় ভয়ংকর সাধনায় মেতে ওঠেন। বস্তুত চড়ক পুজো হিন্দুধর্মের অন্যতম রহস্যময় একটি পুজো। এরপরেই আসে বাংলার নববর্ষ উদযাপন ।
পয়লা বৈশাখের পয়লা নম্বরে হালখাতার সূচনা, দ্বারদেবতাকে তুষ্ট করা, পঞ্জিকা আনা তথা বাঙালির তেরো পার্বণের প্রথম পার্বণ আমাদের “#পয়লা_বৈশাখ” 🙏
বোধ করি বিগত একশতকে এই আমাদের বাঙালীদের একেবারে গতেবাঁধা লোকাচার- দোকানে দোকানে নতুনখাতার উৎসবে খরিদ্দারের সামিল- সঙ্গে করে বাড়ি আনা মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার-
কাকভোরে উঠে কূলবধূ আর কন্যাদিগের পাটভাঙা শাড়ির মায়াময়তায় স্ত্রী আচারের নানান বৈশাখী ব্রত- শিবব্রত, পুণ্যিপুকুর ব্রত, ঘৃত সংক্রান্তি, দর্পণ সংক্রান্তি ব্রত ছাড়াও আঞ্চলিক দেবদেবীর উদ্দেশ্যে পুজো-
বাড়িতে বাড়িতে অতিথি সমাগম- বাঙালি হেঁশেলে ইলিশ আর মুড়িঘন্টে কাগজীলেবুর বাহার- বড্ড চেনা, বড্ড আপন এই চিরন্তন চিত্র।
কিন্তু… ১৪২৬ এর চৈত্র থেকেই বাঙালীর আবেগে জড়িত যতরকম পার্বণে পড়ল ভাঁটা, সেই শুন্যতার হাতেই হাত মিলিয়ে বৈশাখ আমাদের দোড়গোড়ায় পদার্পণ করল- একেবারে অন্য ভাবে, না আছে তাতে উৎসবের আমেজ, না কোন ভালোলাগা
আবেগতাড়িত জনগণকে বুঝিয়ে দিল দূরদেশের এক অতি সুক্ষাতিসূক্ষ প্রাণঘাতী জীবাণুর থেকে আমরা স্তব্ধ হয়ে যেতে পারি!! অতিক্ষুদ্র এককণার দ্বারাও আমাদের স্বাভাবিক রোজনামচা হঠাৎ এমনভাবে বদলে যেতে বাধ্য যা আমাদের পূর্বপুরুষদেরও ভাবনার ঊর্দ্ধে !!
তবু, তবুও… আবার ফিরে আসুক সে স্বাভাবিক ছন্দ, আকাশ পাতাল শুদ্ধ হোক অগ্নিস্নানে-বর্ষণে !!
১৪২৮ এর বৈশাখ আক্ষরিক অর্থে একলা এলেও ধীরে ধীরে তার প্রাচুর্য যেন আমরা বরণ করে নিতে সক্ষম হই ঠিক যেমনটা আগেও ঘটেছে- আবার স্বচ্ছন্দে ফিরুক বারোমাসের “বহুপার্বণ” ।।
শুভ হোক এই নববর্ষ আগের মতই 🙏
।। “অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা” ।।
এতদুপলক্ষ্যে কাঞ্জিকের সমস্ত পাঠককে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা 🙏🙏।
রবীন্দ্রসংগীত ও কত্থক নৃত্যশিল্পী, কথাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও আকাশবাণীর ঘোষিকা। .দেশজ জীবনশৈলীর একনিষ্ঠ ধারক।
Comment here