বসুধাসাদাকালো রঙমাখা

অ্যাজটেকদের হিসেবে ১৮ মাসে বছর হত মেক্সিকোয় –

-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

ইংরেজি নতুন বছর সবে শুরু হয়েছে। তবে জানেন কি, এই পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের উৎস ভারত? আমাদের সৌর পঞ্জিকা গ্রহণ করেছিল আরবরা। সেখান থেকে আরও পশ্চিমেও এই পঞ্জিকা গ্রহণ করা শুরু হয় এবং জুলিয়াস সিজার এটি চালু করেন রোমে। নাম হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। অতি প্রাচীন কালে সৌর-বথছর গণনায় সামান্য ত্রুটি ছিল। সেইই সংস্কার করে করে গ্রেগরিয়ান ও জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার তৈরি হয়। তাই ইংরেজি CE-কে অনেকে ক্রিশ্চিয়ান এরা না বলে কমন এরা বলছেন। মুদ্রায় আজকের বিষয় ক্যালেন্ডায়। মেক্সিকোর মুদ্রায় ছাপা ক্যালেন্ডার। যদিও এটি যে ক্যালেন্ডারই, তা হলফ করে বলা যাবে না।

কোনও কাজের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে ১৭৯০ সালে মেস্কিকো সিটিতে একটি অতিকায় পাথর উদ্ধার হয়। ১২ ফুট ব্যাসের গোল পাথরটিতে চক্রাকারে নকশা করা রয়েছে। ২৫ টন ওজনের এই পাথরের বর্তমান ঠিকানা, মেক্সিকোর ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ অ্যানথ্রোপলজি। এই পাথরটির নাম পিয়েদ্রা দা সোল বা অ্যাজটেক সান স্টোন যেটিক মাঝে রয়েছেন সূর্যের দেবতা তোনাতিউ (Tonatiuh) তোনাতিউকে ঘিরে থাকা চারটি চৌকো প্যানেলে রয়েছে চারটি যুগের প্রতীক। ডানদিকের উপরের কোণে জাগুয়ার, ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ঘুরে পরের চৌকো অংশে বায়ু, তার পরের চৌকো অংশে বৃষ্টি এবং অন্যটি জল। এই অংশটিকে বলা হয় ওলিন, যার বাংলা করলে হয় গমনশীল। অর্থাৎ আগের চারটি যুগ শেষ হয়েছে, এখন আমরা পঞ্চম যুগে রয়েছি যা শেষ হতে পারে ভূমিকম্পের মতো কোনও বিপর্যয়ে। শুধু এইটুকু এইটুকু অংশ ছাপা হয়েছে মেক্সিকোর বর্তমান ১০ পেসো মুদ্রায়। 

এর পরের বাইরের দিকের অংশ রয়েছে মেক্সিকোর ২ পেসোতে। মূল পাথরে ২০ চিহ্ন রয়েছে সেগুলি ২০টি দিনের প্রতীক। মেক্সিকোর প্রতিটি বছর ভাগ করা হত ১৮ মাসে। প্রতিটি মাসে ২০টি দিন। অর্থাৎ ৩৬০ দিন। বাকি পাঁচদিন তারা অপয়া ও দুর্ভাগ্যের বলে মনে করত। ২ পেসো মুদ্রায় এই সব চিহ্নের মধ্যে ১০টি রয়েছে।

পাথরে এর বাইরের অংশে রয়েছে সূর্যের কিরণ যা ত্রিভূজাকৃতির। এগুলি আসলে দিগবিন্দু যা থেকে দিঙনির্ণয় করা যায়। ১ পোসো মুদ্রায় এই অংশটি রয়েছে। সবার বাইরের অংশে দুটি সাপ আছে, একটি উপস্থাপন করছে তোনাতিউ এবং অন্যটি আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা কোয়েটজালকোয়াটলকে (বুধ)। মোটামুটিভাবে ৫ পেসো মুদ্রায় এই অংশটি রয়েছে। যেদিকে মুদ্রার নাম লেখা রয়েছে, সেই দিকেই এই চিহ্নগুলি আছে।

আবিষ্কারের অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই দেবদেবীর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত শিল্পী ফ্রান্সিসকো দে আগুইরাকে নিয়োগ করেন মেক্সিকোর লেখক অ্যান্তনিও দে লিওন ওয়াই গামা। তাঁদের চেষ্টাতেই এটির অবিকল ছবি এঁকে প্রথম ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। তাঁদের কাজ ছাপা হয় ১৭৯২ সালে। প্রথমদিকে পাথরটির বয়স নির্ধারণ করা যায়নি, বিভিন্ন গবেষণায় শেষ পর্যন্ত স্থির হয় এটি ১৪২৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। তবে কী কারণে এটি খোদাই করা হয়েছিল তা জানা যায় না। মনে করা হয়, ইউরোপিয়ানদের আক্রমণের ফলেই এটিকে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।

প্রথমে এই পাথরটিকে ইউরোপের ঔপনিবেশিকরা বিশেষ গুরু দিতে চাননি। একটি একটি ক্যাথিড্রালের দেওয়ালে গেঁথে দেওয়া হয়। তবে পরে, ১৮৮৫ সালে সেখান থেকে খুলে জাদুঘরে রাখা হয়। সময়ের সঙ্গে এটি যেন মেক্সিকোর প্রতীক হয়ে ওঠে। পাথরটি জায়গা পায় জাদুঘরে এবং অন্যতম প্রধান দর্শনীয় হয়ে ওঠে।

পুরো পাথরটির ছবি ছাপা হয় মেক্সিকোর ১ পেসো মুদ্রায় ১৯৫৬৭-১৯৭০ সালের মধ্যে। এই পাথরের নক্সার প্রভাব তাদের বেশ কয়েকটি অন্য মুদ্রাতেও রয়েছে, তবে আংশিকভাবে। যেমন ৫ ও ১০ সেন্টাভোস।

অতিকায় এই পাথরে পাঁচটি যুগের বর্ণনা রয়েছে। দিক নির্দেশের পাশাপাশাশি মাসের হিসেবও রয়েছে যা চিহ্নের সাহায্যে নির্ণয় করা সম্ভব। আকারে এর চেয়ে বড় মাপের ক্যালেন্ডার আর নেই। তাই নতুন বছরে সকলকে শুভেচ্ছা পুরনো এই ক্যালেন্ডার দিয়ে।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here