পুঁথি - পরিচয়

‘খেয়াপারের তরণী’ –

শ্রীমতী ভাস্বতী দত্তের বই ‘খেয়াপারের তরণী’। সাম্প্রতিক এ আর রহমান সুরারোপ সংক্রান্ত বিতর্কের পর  নজরুল প্রসঙ্গ আবারও উঠে এসেছে।

আটাত্তর পাতার  পকেট সাইজের থেকে একটু আয়তনে বড় এই বইটি প’ড়ে ফেলা যায় একটা সন্ধেতে, কিম্বা একটা ট্রেনযাত্রায় বা এক বড় কাপ কফির সঙ্গে বা শীতের  দুপুরে মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে ব’সেই।

অন্তর্জাল যুগে দু মিনিটের ভিডিওও যেখানে মানুষ আজকাল স্কিপ ক’রে ক’রে দেখে, সেখানে বইয়ের এই অবয়বটা খুব জরুরী, কারণ হাতে নিয়ে পাতা ওল্টানোর জন্য আজকের ব্যস্ত পাঠক সহজেই তুলে নেবে এই নিতান্ত হাল্কা বইটি ; এবং তারপর এক সাবলীল সুখযাত্রা। মুনশিয়ানার সঙ্গে লেখিকা বইটি শুরু করেছেন নজরুল জীবনের নানান অ্যানেকডট দিয়ে যেগুলির অভিনবত্ব,মজা,সতেজতা পাঠককে এতটাই চমৎকৃত করে যে নিতান্ত অজ্ঞ, নজরুল অপরিচিত মানুষের কাছেও আগ্রহের বিষয় হ’য়ে ওঠেন গল্পের কেন্দ্রবিন্দু মানুষটি,এবং সে পাঠক হয়তো তাঁর অজান্তেই উলটে যেতে থাকেন পাতার পর পাতা।গুণগত বিচারের গভীরে  যাবার আগে বলা যায়, বইটির এ এক বড় সাফল্য ; যেখানে একজন নিতান্ত নজরুল অপরিচিত  মানুষও এক ঝলকে কয়েকটা ঘটনার মাধ্যমে এক আলোকিত টাটকা হাওয়ার মত ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়ে, আরও জানার জন্য পাতা ওল্টায়।

অ্যানেকডট প্রসঙ্গে বলা যায়, নজরুল নিয়ে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকা মানুষের কাছেও গল্পগুলি নতুন লাগতে বাধ্য। ‘বে-লুচিস্তান”, “আমপাড়া’, ‘ঘাস ফোটানো জলের চা খাওয়া’ বিশেষ ক’রে ‘পাণিগ্রহণ’ গল্পটি থেকে ম’নে হয় সত্যিই এই লোকটিই লিখতে পারেন, ‘আমার খোকার মাসী/শ্রী শ্রী অমুকবালা দাসী”।

বন্ধু শৈলজানন্দের সঙ্গে অনাবিল সখ্যের যে দু একটি

ছবি তুলে ধরেছেন লেখিকা,তা থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক পরবর্তীতে যে পথে এগিয়েছিল,তার প্রথম পর্বের আভাস মেলে। আজকের দিনের ছোটদের কাছে বোধহয় এ কল্পজগত ব’লে ম’নে হতে পারে,যেখানে গভীর আঘাত নিয়েও এক ছোট্ট ছেলে ছুটে চলেছে বন্ধুর জন্য নিমডাল আনতে, বন্ধুর ক্ষতে নিমপাতা প্রলেপ দেওয়া হবে ব’লে।

এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পর্ব হচ্ছে ‘লেটোর গান ও নজরুল’ পর্বটি। সাংবাদিক নজরুল,সৈনিক নজরুল, ভক্ত নজরুল, প্রেমিক নজরুল,কবি নজরুল নিয়ে আলোচনা সর্বত্রই মেলে। কিন্তু ‘লেটো গান গায়ক নজরুলের’ কথা উল্লেখ থাকলেও,ঐ পর্যন্তই। এর বিশদ আলোচনা তুলনায় খুব কমই আসে। এই বইয়ের লেখিকা তাঁর প্রতিটা পালাগানের উল্লেখ ক’রে ক’রে লেটো পালাকারের ভাষাগত ক্রম-উত্তরণের যে সহজ চিত্র পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন,তা এক কথায় অনবদ্য। বাঁশী,ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের স্বভাবশিল্পী দুখু যখন লেখেন,

” পাল্লা সাথে লেটোর ল্যাঠা লাগল/ছড়াদার ও দোহাররা সব ভাগল/ওদের ছন্দ সুরের মিল নাইকো গানেতে/ওদের মাটির সাথে আকড়া মিশাল ধানেতে/ ষাঁড়ের সাথে গাধা বাঁধা থানেতে/দেখে ইহা ভদ্রলোক লাগল” তখন যে ভাষাগত অনৈপুণ্য ও অমার্জিত প্রকাশ আমাদের চোখে পড়ে,পরবর্তীতে যখন লিখছেন, ‘নিষ্প্রভ এ শশী,তব বদনশশী/বেরোলো না হাসি শশী মুখে/পূরব আকাশে রবি প্রায় সমাগত/কোকিলা ঝংকারে কুহু অবিরত /তব মুখের আভা/যেন বিদ্যুৎপ্রভা/পরিণত শোভা ক্ষীণালোকে ‘- তখন তাঁর পরিশীলিত কাব্যে আমরা তাঁর রচনার ট্রানজিশন প্রত্যক্ষ করতে পেরে চমৎকৃত হই। এই তুলনামূলক পরিবেশনার জন্য লেখিকা অবশ্যই ধন্যবাদের দাবিদার।

একইভাবে ‘পরিণয় সাহিত্যে নজরুল’ পর্বটিও বেশ অন্য স্বাদ আনে। প্রেমিক নজরুলের কবিতা, গজলে মুগ্ধ পাঠককূলকে আরও একবার আন্ডারলাইন ক’রে দেখানো যে প্রেম বিরহের পাশাপাশি পরিণয় নিয়েও লেখনী তাঁর মধুর মুখর।

ভক্ত নজরুল – এই পর্বে নজরুলের মাতৃসাধনা বিষয়ক এমন কিছু তথ্যসমাহার লেখিকা করেছেন, যা বিস্ময়কর এবং নজরুলের সাধনপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের সহায়তা করে। বীরভূমে ফুল্লরা দেবীপীঠে তাঁর সাধনা ,নিজগৃহে মূর্তি প্রতিষ্ঠা,স্বরচিত শ্যামাসংগীত সহযোগে  রোজ কালীপূজা, গৈরিক ধারণ,’ নিরামিষাহার – এগুলি পাঠকের সামনে এক অন্য নজরুলকে উপস্থিত করে। ছোটবেলায় ইমামতি,খাদেমগিরি করা কবির এ হেন মাতৃসাধনা ও তন্ত্রসাধনা স্বয়ং তারাশঙ্করের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘শক্তিতত্ত্ব ও মাতৃস্বরূপের নব ভাষ্যকার’ আখ্যা দেন।

নজরুলের কালীউপাসনা বলতে বরদাচরণ মজুমদারের নাম প্রাসঙ্গিকভাবেই সামনে আসে। কিন্তু  আরও প্রণম্য মানুষজন যে জড়িয়ে রয়েছেন এই প্রসঙ্গে অতি স্বল্প পরিসরেও লেখিকা সেই আভাসটুকু তুলে ধরেছেন।

গজল লিখিয়ে নজরুল, কৃষ্ণভক্ত নজরুল, গানে নজরুল, নজরুল প্রমীলা- এই পর্বগুলি যথাযথ, কিন্তু তার মাঝেও তাঁর সন্তানের সঙ্গে কথোপকথন, সন্তান হারাবার পর তাকে একবার দেখার জন্য তাঁর  যাবতীয় আধ্যাত্মিক প্রয়াসের যে  তথ্য এত সুচারুভাবে উপস্থাপন  করেছেন যে,বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ, ‘তরোয়াল দিয়ে দাড়ি চাঁচা’ ইত্যাদি ঘটনাই আলোচনা হয় ঘুরেফিরে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে গীতাঞ্জলির সকল গান স্মরণে রাখা নিয়ে  অন্যত্র কবির মুগ্ধ প্রশংসা করেছেন,সত্যেন দত্তের স্মরণসভায় তাঁকে পাশে ডেকে বসিয়েছেন,তা এই পেপারব্যাক বইটি আমাদের নতুন করে জানায়।

আসি এবার অন্যকথায়। বইটি সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তি নজরুলের জীবনচিত্রণের উদ্দেশ্যে লিখিত বলেই বোধ হয়  তাঁর রাজনৈতিক জীবন, মোহিতলাল মজুমদার  প্রসঙ্গ বা মুজফফর আহমেদ প্রসঙ্গ সেভাবে আসে নি।কিছু  রিপিটেশন (হুগলী জেল এবং অনশন ভাঙা পর্ব)হয়তো ভুলক্রমেই ঘটেছে ;কিন্তু হাল্কাচ্ছলে  যেভাবে নজরুল জীবনকে তুলে ধরেছেন তার সামগ্রিকতায়,তা প্রশংসার দাবী রাখে। মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে ব’লে ম’নেই পড়ে না,এবং রুচিশীল ছিমছাম  প্রচ্ছদ বইটিকে ‘সহজে প’ড়ে ফেলতে পারার আগ্রহ তৈরী করে পাঠকের মধ্যে – এখানেই বইটির, লেখিকার এবং প্রকাশকের সার্থকতা।

Comment here