–
– শ্রী রণদৃপ্ত শীল
“মহে। ইহা বুঝিতে পারি না। সন্তানেরা বৈষ্ণব কেন? বৈষ্ণবের অহিংসা পরম ধর্ম।
সত্য। সে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব। নাস্তিক বৌদ্ধধর্মের অনুকরণে যে অপ্রকৃত বৈষ্ণবত্ব উৎপন্ন হইয়াছিল, এ তাহারই লক্ষণ। প্রকৃত বৈষ্ণব ধর্মের লক্ষণ দুষ্টের দমন, ধরিত্রীর উদ্ধার। কেননা, বিষ্ণুই সংসারের পালনকর্তা। দশবার শরীর ধারণ করিয়া জগতের উদ্ধার করিয়াছেন। কেশী, হিরণ্যকশিপু, মধুকৈটভ, মুর, নরক, প্রভৃতি দৈত্যগণকে, রাবণাদি রাক্ষসগণকে, কংস, শিশুপাল, প্রভৃতি রাজগণকে তিনি যুদ্ধে ধ্বংস করিয়াছিলেন। তিনি জেতা, জয়দাতা, পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা ও সন্তানের ইষ্টদেবতা। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম নহে – উহা অর্ধেক ধর্ম মাত্র। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু প্রেমময় – কিন্তু ভগবান শুধু প্রেমময় নয় – তিনি অনন্তশক্তিময়। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু শুধু প্রেমময়; সন্তানের বিষ্ণু শুধু শক্তিময়। আমরা উভয়েই বৈষ্ণব কিন্তু উভয়েই অর্ধেক বৈষ্ণব। কথাটা বুঝিলে?
মহে। বুঝিলাম। তবে সন্তানেরা উপাসকসম্প্রদায় মাত্র?
সত্য। তাই। আমরা রাজ্য চাহি না – কেবল – মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।”
লেখার প্রারম্ভে কিছু কথোপকথন তুলে ধরলাম।
সেগুলির চর্বিতচর্বণ নিষ্প্রয়োজন। বাংলা সাহিত্যের সর্বোত্তম, ইংরাজি সহ বহু ভাষায় অনূদিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’র অন্তর্গত উল্লেখিত উক্তিগুলি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে রচিত এই উপন্যাসটি তৎকালীন বিদেশি শাসিত ভারতবর্ষে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। উপন্যাসটির প্রণেতা ঋষী শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বলতে গেলে বাংলা সাহিত্য সমাজের তিনি প্রথম মহারথি, যিনি আপন লেখনী প্রতিভার মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লববাদ কে শক্তি জোগানোর দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, এমন অনেক মানুষের, যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে বিপ্লবীদের কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে তাঁদের সাহায্য অবশ্যই করেছিলেন। কেউ গান গেয়ে, কেউ বা গল্প কবিতা ও উপন্যাস রচনার মধ্যে দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন শেষোক্ত শ্রেণীর মধ্যে অগ্রগণ্য। অথচ বাঙালির নিকট সাহিত্য সম্রাট উপাধি লাভ করেও আজও তিনি বিতর্কিত!
১৮৩৮ সালের ২৭শে জুন কাঁঠালপাড়া গ্রাম নিবাসী যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দূর্গাসুন্দরী দেবীর গৃহ আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঋষী বঙ্কিমচন্দ্র। শৈশবে নিজের গ্রামে পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ভর্তি হয়েছিলেন হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। ১৮৫৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। তারপর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের পদমর্যাদা লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনে তাই তাকে বাংলাদেশের (অবিভক্ত) অনেক স্থানে পরিভ্রমণ করতে হয়েছে। আর সেই পরিভ্রমণ কালেই তিনি অতি নিকট হতে দেখতে পেয়েছিলেন স্বজাতির উপর ইংরাজের অত্যাচার। অনুভব করেছিলেন স্বাধীনতার প্রয়োজন। সরকারি পদে আসীন বলে কোনদিন প্রত্যক্ষ রূপে বাংলার বিপ্লবী কর্মকান্ডে শরিক হতে পারেননি তিনি। তাই নিজের কলমকে বানালেন প্রধান অস্ত্র। শোনালেন বাঙালিকে স্বাধীনতার অমূল্য বাণী। তাঁর উপন্যাস স্বাধীনতার কথা বলে। আনন্দমঠ উপন্যাসে স্বাধীনতা, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের চমৎকার বর্ণনা বঙ্কিমচন্দ্র করেছেন। এই উপন্যাস টিই পুনরুত্থান ঘটিয়েছিল ভারতীয় বিপ্লববাদের। এই উপন্যাসটিকে “Bible of Indian Patriotism” নামে আখ্যায়িত করা হয়। ভারতের জাতীয় গীত “বন্দে মাতারম” এই উপন্যাসেরই অন্তর্ভুক্ত, সুর দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীত শিল্পী যদুভট্ট (যদুনাথ ভট্টাচার্য)। পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন রবি ঠাকুর। বিভিন্ন বৈপ্লবিক সংগঠন, সংবাদপত্র, এমনকি স্বদেশীদের গোষ্ঠীগত যুদ্ধনাদের (স্লোগানের) জন্মদাত্রী হয়ে উঠেছিল এই “বন্দে মাতারম” গানটি। এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। কিন্তু এ গানটি যেমন জনপ্রিয় তেমনি এর বিরুদ্ধে উঠে এসেছে নানা বিতর্ক। সে কথায় পরে আসছি।
এবার একটি প্রশ্ন অবশ্যই উঠে আসে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস কি শুধুই বিপ্লববাদ কে কেন্দ্র করে? উত্তর হবে, না। বঙ্কিম বাবুর উপন্যাস শুধু একটি কথা বলে – স্বাধীনতার কথা! মুক্তি সংগ্রাম ও অবশেষে মুক্তিলাভের কথা! ইতিহাসের বিভিন্ন চরিত্রের প্রণয়, অভিমান, ঘাত প্রত্যাঘাতের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয় তাঁর চিরোজ্জ্বল লেখনীতে। এই স্বাধীনতা মূলত দু’টি প্রকারের। সর্বপ্রথম হলো ব্যক্তি স্বাধীনতা। ব্যক্তি স্বাধীনতা না থাকলে একটি দেশ ও জাতির স্বাধীনতা অসম্ভব। নানা কারণে আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব। তাই নারীর এই স্বাধীনতাকেই শৃঙ্খলমুক্ত করতে তাঁর উপন্যাসের পাতায় উঠে এসেছে একের পর এক অসমসাহসী নারী চরিত্র। তাঁর সাহিত্যজীবনের ঊষালগ্নে রচিত “Rajmohan’s Wife” উপন্যাসে উঠে এসেছিল এমনই একটি চরিত্র মাতঙ্গিনী। স্বামী রাজমোহনের কাছে শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েও, এবং মথুরবাবুর কুপ্রস্তাবে সম্মত না হয়েও তার হাতে বন্দী হয়েও আপন সংগ্রামে অনড় ছিলেন মাতঙ্গিনী। কি লাভ করতে চেয়েছিলেন তিনি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা! যে কোন পরিস্থিতিতেই ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে। সে ‘দেবী চৌধুরাণী’র প্রফুল্ল হোক, ‘চন্দ্রশেখরে’র শৈবলিনী, ‘দূর্গেশনন্দিনী’র বিমলা ও আয়েষা, কিংবা ‘আনন্দমঠে’র বীরাঙ্গনা শান্তিমণি ‘পাপিষ্ঠা’। আজকের দিনে, যেখানে ‘ফেমিনিজম’ বা নারীবাদ সমাজে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে, সেখানে তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলি অবশ্যই মানুষের মনে দাগ কাটবে।
এরপরেই আসে দেশের স্বাধীনতা বা জাতির স্বাধীনতা। পরাধীনতার গ্লানি যে কি ভীষণ গ্লানি, তা ফুটে উঠেছে বঙ্কিম বাবুর ঐতিহাসিক উপন্যাসে। হিন্দুর পুণ্যভূমি এই ভারতবর্ষে ইসলামের ধ্বজা উড়িয়ে আগত যবন, পাঠান, মোগলদের লাগাম ছাড়া অত্যাচারের কথা বলে সেই উপন্যাস গুলি। আর সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত সনাতনীদের প্রতিবাদের জয়গাথাই হয়তো দেশবাসীর মনে জাগরণ ঘটিয়েছিল অনন্তকাল যাবৎ ঘুমিয়ে থাকা বিপ্লবের এক আগ্নেয়গিরিকে! যার বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বৃটিশ রাজশক্তি। আর এটাই চেয়েছিলেন ঋষী বঙ্কিমচন্দ্র। প্রত্যক্ষ ভাবে বৃটিশের নিন্দা তিনি করতে পারতেন না ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বলে। তাই ঐতিহাসিক এসব প্রতিরোধের ঘটনাবলী নিয়ে তৈরী করেছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস। আনন্দমঠে’র মহম্মদ রেজা খাঁর রোষানলে জর্জরিত বঙ্গদেশের মধ্যে তৎকালীন বৃটিশ শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারতবর্ষের করুণ ছবি দেখতে পেয়েছিল দেশবাসী। আজো ‘আনন্দমঠ’ পড়লে আবালবৃদ্ধবনিতার লোম খাড়া হয়ে ওঠে। তাই ত এটি হয়ে উঠেছিল ভারতীয় বিপ্লববাদের ধর্মগ্রন্থ। আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়েছিলেন ‘সাহিত্য সম্রাট’।
সেই সময় এবং লজ্জার বিষয়, আজো, এমন মানুষ আছেন, যাঁরা এই প্রবাদপ্রতিম, প্রথিতযশা মানুষটির রচিত উপন্যাস ও অন্যান্য সৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা খোঁজেন এবং তাঁকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে উঠে পড়ে লাগেন। একাধিক ইসলামী সংগঠন ফতোয়া জারি করেছিল প্রখ্যাত ‘বন্দে মাতারম’ সঙ্গীতটির বিরুদ্ধে, কারণ এই সঙ্গীতে নাকি রয়েছে হিন্দুত্ব ও পৌত্তলিকতার কথা! বিষ্ণু বসু ‘বঙ্কিম রচনাবলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “মহম্মদ আলি জিন্নাহ যে এগারো দফা পেশ করেছিলেন, তার প্রথম দফাই ছিল, ‘The Bande Mataram song to be given up’. শুধু অংশ বর্জন নয়, পুরো সঙ্গীতটির বর্জনই তখন অন্যতম দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।” দুঃখের বিষয়, মুসলিম লীগের দাবী মেনে কংগ্রেস ওয়ার্কং কমিটি এই গানটির অঙ্গচ্ছেদ করেছিল।
বছর দুয়েক পূর্বে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়। লেখক, মুহম্মদ হেলালউদ্দীন। তিনি লিখেছিলেন, “সত্যানন্দ বলিলেন, ‘‘আমরা রাজ্য চাইনা— কেবলমাত্র মুসলমানরা ভগবান বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশ নিপাত করিতে চাই।’’ (দ্বিতীয় খণ্ড: চতুর্থ পরিচ্ছেদ) ইত্যাদি। এগুলি বঙ্কিমচন্দ্রের সুস্পষ্ট মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক মানসিকতারই ফসল।” এই কথাটি সর্বৈব অসত্য। কারণ এই উক্তিটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নয়, ওঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্গত একটি চরিত্রের। যে পটভূমিকা কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে এই উপন্যাসের, সেই সময় সমগ্র বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষে ইংরাজের রাজত্ব পুরোপুরি কায়েম হয়নি। তখনো রাজত্ব ছিল ইসলামী শাসক দের হাতে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, আমরা বুঝতে পারি, বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনের পতনের পর বাংলা চলে আসে, যবন বখতিয়ার খিলিজির হাতে (এই পুরো ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে তাঁর ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে)। ক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষ চলে আসে তাদের দখলে। তারপর কয়েক শতাব্দী ধরে চলে বাংলায় “মহম্মদীয়” শাসন। একের পর এক মসনদের দখল নেয় তুঘলক, মমলুক, পাঠান, মোগল। আর এই সময়কালে চলেছিল অবিরাম হত্যা, ধর্ষণ, লুঠ থেকে শুরু করে মন্দির ধ্বংস ও তীর্থস্থান ভ্রমণের জন্য হিন্দুদের উপর কর লাগু করা পর্যন্ত অনেক অত্যাচার তারা করেছিল। নবাব মীর্জাফরের বিলাসিতা ও ইংরাজের চাতুরির ফল, বাংলায় ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সন্তান দল বা হিন্দু সন্ন্যাসীদের ক্রোধ ও বিতৃষ্ণা ছিল এই নির্বাপিত-প্রায় মুসলমান সাম্রাজ্যের উপর। তাই আনন্দমঠে’র সত্যানন্দ বলেছিলেন, “আমরা রাজ্য চাইনা। মুসলমান ভগবানের বিদ্বেষী, তাই তাদের সবংশ নিপাত করিতে চাই।”
এই উক্তিটি তৎকালীন প্রজাদের বিতৃষ্ণার মনোভাবটি প্রতিফলিত করে। ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস বা কাহিনী রচনা করতে এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ করতে হয়, যা অন্যের নিকট অপ্রীতিকর লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। অতীত অপরিবর্তনশীল। মূল কথা হল, তার জন্য সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকার প্রমাণ হয় না।
হেলালউদ্দীন সাহেব এরপর বন্দে মাতারম সংগীতটি নিয়ে লিখেছেন,
“গানটি পৌত্তলিক, ভারতের অনেকেই পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করেন না, দূর্গা সর্বভারতীয়ও নন, বহু মানুষ দূর্গাপুজো করেন না। যেমন খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম, শিখ, বস্তুবাদী, মানবতাবাদী, নাস্তিক, অসুর-পূজক। এ নিয়ে তাঁদের আপত্তি থাকতেই পারে। তাঁদের উপর জোর জবরদস্তি করার অধিকার কারও নেই।”
খুব ন্যায্য কথা! অবশ্যই আমাদের ইষ্ট দেবী বা দেবতাকে মানতে এবং বিশ্বাস করতে আমরা অন্য কোন ধর্মের মানুষকে বাধ্য করতে পারি না। এটাও কিছু ক্ষেত্রে ঠিক যে, মা দূর্গা সর্বভারতীয় নন (যদিও ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে, নানা রূপে তিনি পূজিতা হন)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কখন ও কিভাবে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র পৌত্তলিকতার কথা চাপিয়ে দিলেন ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর? ‘ত্বং হি দূর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী’ এই লাইনটি নিয়ে কিছু ইসলামী সংগঠন এবং তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষদের আপত্তি আছে। এই লাইনে মাতৃভূমিকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মানুষের কাছে তাঁর দেশ, তাঁর মাতৃভূমি। সেই মাতৃভূমিকে সে ঈশ্বর সম ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে সে। আমাদের মাতৃভূমির মধ্যেই আমরা আমাদের ঈশ্বরকে দেখতে পাই। কারো কাছে তিনি দূর্গা, কারো কাছে খোদা, কারো কাছে আবার গড। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ, তাই তিনি তাঁর মাতৃভূমি কে দেখেছেন ‘দশপ্রহরণ ধারিনী’ দেবী দূর্গার মতো। আর তাই ‘সুজলং সুফলং মলয়জশীতলম’ এই বঙ্গদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন আনন্দমঠের সন্ন্যাসীরা। সংসার, প্রণয়, বিলাস, অভিলাষ সব তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল এই স্বপ্নের কাছে। যদিও এই উপন্যাসের শেষে জানা যায়, যে নবাবী শাসনের পতন ঘটলেও রাজ্য চলে যায় ইংরাজের হাতে। প্রকৃত অর্থে তাই ঘটেছিল। কিন্তু আনন্দমঠ বাঙালি তথা ভারতীয়দের শিখিয়েছিল চরম আত্মত্যাগের পরিভাষা।
১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের পর যে বিপ্লব নিদ্রিত হয়েছিল বাঙালি তথা ভারতীয়দের বুকে, তা পুনরুজ্জীবিত হল এই উপন্যাস পড়ে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ এই উপন্যাস পড়ে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হল। ভিন্ন পটভূমিকায় রচিত হলেও এই উপন্যাসের শক্তি এবং এর গভীর অর্থ তারা বুঝতে পেরেছিল। পেরেছিল লালমুখো সাহেবরাও, কিন্তু তাদের বুঝতে অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিল। তখন মানুষের হাতে হাতে আনন্দমঠ এর বই, তাদের মুখে মুখে ফিরছে বন্দে মাতারাম। তাই তো একসময় এই গান গাওয়া বর্জন করেছিল ইংরাজরা। আর একটি কথা বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা ‘সাম্প্রদায়িক’ তত্ত্বটি কে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেবে। তা হল, তাঁর অন্যতম একটি উপন্যাস ‘দূর্গেশনন্দিনী’। ইতিহাস প্রমাণ করে, যে একদা উন্নত এই ভারতবর্ষে বারংবার আক্রমণ করেছিল যবনেরা। গণধর্ষণ আর বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের পর্ব চলেছিল। যবন কর্তৃক ধর্মান্তকরণের সেই কাহিনী ফুটে ওঠে তাঁর সেই উপন্যাসে। কিন্তু সে উপন্যাসে যেমন রয়েছে অত্যাচারী, ধূর্ত, নারীলোলুপ পাঠান শাসক কতলু খাঁ, ঠিক তেমনি রয়েছে পরমাসুন্দরী, অসীম স্নেহময়ী, কোমল হৃদয়া আয়েষা। পিতা কতলু খাঁর স্বভাবের একেবারে বিপরীতধর্মী ছিল সে। আহত কুমার জয়সিংহের পরিচর্যার দায়িত্ব ভার যে নিয়েছিল।
সেই সময় কতলু খাঁর সেনাপতি ওসমান খাঁয়ের সাথে হওয়া আয়েষার কথোপকথন তুলে ধরলাম:
“ওসমান কহিলেন,”আয়েষা! তোমার গুণের সীমা দিতে পারি না; তুমি এই পরম শত্রুকে যে যত্ন করিয়া শুশ্রূষা করিতেছ, ভগিনী ভ্রাতার জন্য এমন করে না। তুমি উহার প্রাণদান করিতেছ।
আয়েষা ভূবনমোহন মুখে একটু হাসি হাসিয়া কহিলেন, “ওসমান, আমি তো স্বভাবত রমণী; পীড়িতের সেবা আমার পরম ধর্ম, না করিলে দোষ, করিলে প্রশংসা নাই।….” “।
উক্ত কথাগুলিতে পাঠান দুহিতা আয়েষার স্নেহময়ী ভাব স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়। কুমার জয়সিংহের পরিচর্যা করতে করতেই তাঁর প্রেমে পড়ে আয়েষা। যদিও সে প্রেম বিবাহের পরিণতি লাভ করেনি। কারণ জয়সিংহ (নায়ক) আর মহারাজ বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা, তিলোত্তমা (নায়িকা) একে অপরকে ভালোবাসতো। ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের পার্শ্ব নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও বিপুল বাধা পেরিয়ে নায়ক নায়িকার মিলনে এক সক্রিয় ভূমিকা ছিল আয়েষার। পাঠান কতলু খাঁর বর্বরতায় যেমন ক্রুদ্ধ হয়েছিল মানুষ, ঠিক তেমনই উপন্যাসের শেষে এই পাঠান কন্যার আত্মত্যাগ অশ্রুসজল করে দিয়েছিল তাদের চোখ। তাহলে কেন আত্মত্যাগ, সাহস ও প্রেমের প্রতীক হিসাবে তিনি তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরলেন এক মুসলমান কন্যাকে? সাম্প্রদায়িক হলে এতটা উন্মুক্ত মনে পারতেন না এ কাজটি করতে। এই একটি চরিত্রের অপরূপ বর্ণনা ও তাঁর যথার্থ উপস্থাপন তাঁর বিরুদ্ধে পেশ করা ‘মুসলিম বিদ্বেষী হওয়ার’ তত্ত্বটি কে ভিত্তিহীন করে দিচ্ছে। শুধু, যবন কৃত অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদের অত্যুজ্জ্বল অতীতের কথা, তিনি তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বলে কি করে তিনি সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হয়ে উঠলেন, সেটাই ভাবনার বিষয়।
বঙ্কিম সাহিত্য, বিশেষ করে ‘Bible of Indian Patriotism’ আনন্দমঠ নিয়ে নিন্দার ঝড় তুলেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উষালগ্নের খ্যাতনামা নেতা মুজাফফর আহমেদ! ইতিহাসবেত্তা ডঃ হোসেন রান্দাথানি তাঁর ‘MUZAFFAR AHMED , THE KAKABABU OF INDIAN COMMUNISTS’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ” Muzaffar Ahmad himself gives the character of the Terrorist movements, active in Calcutta under Hindu Badralok : “Considering my mental condition in the second decade of this century, and the romance that lay in the terrorist movement, it was not possible for me to join the terrorist revolutionary camp, but there were certain obstacles in the way. The terrorist revolutionaries drew their inspiration from Bankim Chanra Chatopadhya’s Anantha Math. This book was filled with communal ill will from the beginning to the end. The fundamental message of the book lay in Bankim Chandra’s invocation Vande Mataram. The song contains the lines:
“Thou, as strength in arms of men
Though, as faith in hearts, dost reign
And from fane to fane
Thine,Oh.Goddess
For, though hast ten armed Durga’s power….”4
Muzaffar asks: “How could a monotheist Muslim youth utter this invocation? No Hindu Congress leader was able to understand this. The terrorist revolutionary movement in Bengal was definitely anti- British, but it was also a Hindu revivalist movement; its aim was the restoration of Hindu rule.”5
আহমেদ সাহেবের বক্তব্য থেকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি তাঁর তীব্র ঔদাসীন্য প্রকাশ পায়। ভারতের জাতীয় আন্দোলন কে তাঁর কেন যে হিন্দু পুণর্জাগরণের আন্দোলন বলে মনে হল, তা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন! কারণ সেই আন্দোলনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন! বঙ্কিম বাবুর ‘বন্দে মাতারম’ মুসলিম যুব সমাজের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে তার চিন্তার শেষ ছিল না! বলাই বাহুল্য, সেই চিন্তা একেবারেই ভ্রান্ত! সঙ্গীত টি নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “How could a monotheist Muslim youth utter this invocation? No Hindu Congress leader was able to understand this.” এ কথা বলার সময় তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, যে বন্দে মাতারম সঙ্গীত সর্বপ্রথম কংগ্রেস অধিবেশনে পরিবেশিত হওয়ার সময়, প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ রহমতুল্লা সায়ানী। শুধু সায়ানী নন, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, রফি আহমেদ কিদোয়াইয়ের মত মুসলিম ব্যক্তিত্বরাও সাদরে গ্রহণ করেছিলেন সঙ্গীত টি কে। কাকাবাবুর এই বক্তব্য, তাঁর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনের ফসল! ধর্ম বর্ণের সংকীর্ণতার বিরোধিতা করার জন্য প্রসিদ্ধ যে দল, তাদের একজন হয়ে আহমেদ সাহেবের এ হেন চিন্তা সত্যিই বড় আঘাত দেয়।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন, “বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি”। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা এই ভিত্তিহীন অভিযোগগুলিই শাস্ত্রী মহাশয়ের এই কটূ সত্যকথাটি কে প্রমাণ করে। আমার মতে, তাঁর মত মানুষের বিরুদ্ধে এমন অপমানজনক ও নীচ অভিযোগ নিয়ে এসে আপন মূর্খতা প্রদর্শন না করাটাই বাঞ্ছনীয়।
বাংলা সাহিত্যে নব পদ্ধতিতে, অর্থাৎ, সংস্কৃত নির্ভরশীল বাংলা থেকে সাধু ভাষায় উপন্যাস রচনা করেছিলেন সর্বপ্রথম, বঙ্কিমচন্দ্র। উপন্যাস ছাড়াও লিখেছেন কবিতা, প্রবন্ধ, ইত্যাদি। জমিদার মুচিরাম গুড় ও ‘নীলদর্পণে’র প্রণেতা দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী লিখেছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে সাহিত্য রচনায় ক্ষেত্রে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলেন দ্বিতীয়া অর্ধাঙ্গিনী রাজলক্ষ্মী দেবীকে। এ কথা স্বীকার করেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। এই প্রবাদপ্রতিম, যশস্বী মানুষটির মৃত্যু ঘটে ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল। এই প্রবাদপ্রতিম, যশস্বী মানুষটির মৃত্যু ঘটে ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল। যতদিন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থাকবে মানুষের মধ্যে, ততদিন স্বাধীনতার প্রবক্তা এই মানুষটির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তথ্য সূত্র:
১) উইকিপিডিয়া
২) সম্পাদক সমীপেষু : সাম্প্রদায়িক বঙ্কিম – মুহম্মদ হেলালউদ্দীন (আনন্দবাজার পত্রিকা)
৩) MUZAFFAR AHMED, THE KAKABABU OF INDIAN COMMUNISTS – Dr. Hussain Randathani
৪) বঙ্কিম রচনাবলী (উপন্যাস সমগ্র)
লেখক পরিচিতি: শ্রী রণদৃপ্ত শীলের জন্ম রূপের তিলোত্তমা এই কলকাতা নগরীতে। প্রিয় লেখক, যশস্বী সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখালেখির শুরু। সমাজের অবহেলিত বারবণিতাদের নিয়ে লেখা তার কবিতা “রক্ষিতা” অচেনা অতিথি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে ২০১৯। এর মাধ্যমেই সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে তার। তার লেখা গল্প ও অনুবাদের অডিও রূপান্তর হয়েছে বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেলে। প্রকাশিত বই: টারজান ফিরে এলো (অনুবাদ)
Comment here