(পূর্বের সংখ্যার পর)
– সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
🔷 বহিরাগত আক্রমণ প্রতিরোধে হিন্দু রাজ্যসমূহ 🔷
সেন বংশ এবং দেব বংশের বাঙ্গালা সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র বাংলা জুড়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য রায়শ্রেষ্ঠ বঙ্গাধিপতি মহারাজা প্রতাপাদিত্য এর যশোর সাম্রাজ্য ছাড়া আর তৈরি হয়নি। কিন্তু তা বলে বাঙালির প্রতিরোধ ও ক্ষাত্রবীর্যের ইতিহাস শেষ হয়ে যায়নি। এই সময়ে যবন আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন বাঙ্গালার স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের রাজারা।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই রাজ্যগুলি কে নিয়ে গবেষণা ধর্মী কাজ হয়েছে খুব কম এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোককথা ও বংশকুলজির উপর আমাদের ভরসা করতে হয়। এছাড়াও এই বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে নানা জায়গায় বাইরে থেকে আসা রাজার সন্তান যাঁকে উক্ত রাজ্যে ফেলে চলে যাওয়া হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি এক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন দেখানো হয়েছে। এইগুলি নেহাত ই গল্পকথা এবং এদের ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। আসলে শাহি সালতানাত আমলে সুলতানদের মদতপুষ্ট কিছু গণক এইকথা ঘোষণা করেন যে বাংলার সমস্ত রাজবংশ আসলে শূদ্র, ক্ষত্রিয় কেউ নয়। তাই নিজেদের ক্ষত্রিয় প্রমাণ করতে রাজাদের বাইরে থেকে আসার গল্প ছড়ান; বিনয় ঘোষ, তরুণদেব চক্রবর্তীর মতন মহান ঐতিহাসিক যাঁরা এইসব ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন, তাঁরাও এই কথাই বলেছেন।
🔶 শিখরভূম রাজ্য 🔶
শিখরভূম রাজ্য যা পঞ্চকোট রাজ বা কাশীপুর রাজ নামেও পরিচিত পুরুলিয়া মানভূম অঞ্চলে প্রায় ১৯০০ বছর রাজত্ব করেন। প্রায় ১,৯০০ বছর আগে ঝালদায় এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয়। ঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট, মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় এবং সর্বশেষ কাশীপুর— এই সাতটি রাজধানী থেকে পঞ্চকোটের রাজারা শাসন করতেন। মানভূমের সভ্যতা সৃষ্টিতে এই রাজবংশ অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
ধর্ম আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, জেলার ২২টি জনপদ নির্মাণ, বিভিন্ন জাতির বসতি বিস্তারে আনুকূল্য দান, মন্দির-স্থাপত্য শিল্পের প্রসার, দেশপ্রেমিক প্রজাদের নিষ্কর মৌজা বিতরণ এবং জনজাতিগুলির সঙ্গে রাজ পরিবারের আত্মিক সম্পর্ক রাজ পরিবারটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, ধানবাদ, বোকারো ও রাঁচি জেলার ২,৭৭৯ বর্গমাইল এলাকায় পঞ্চকোটের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। কটকের ডালিজোড়া ও বারাণসীতেও পঞ্চকোটের জমিদারি ছিল। গঙ্গাতীরে ‘পঞ্চকোট ঘাট’ এখনও বিদ্যমান।
প্রায় ১,৯০০ বছরের শাসনকালে পঞ্চকোট রাজপরিবার কোনও প্রজা বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়নি। উপরন্তু, রাজ পরিবারটির অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে, এমনকি, রাষ্ট্রবিপ্লবে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রজারা। দুই সহস্রাব্দ রাজত্ব করার পরেও শিখরভূম রাজাদের সম্বন্ধে খুবই কম ইতিহাস লেখা হয়েছে। এই রাজ্যের প্রখ্যাত রাজন্যদের কথা নিম্নে আলোচিত হলো।
🟠 মহারাজা দামোদর শেখর দেব/দেও 🟠
মহারাজা দামোদর শেখর দেও ছিলেন শিখরভূম এর প্রতিষ্ঠাতা। আনুমানিক ৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন রাজধানী ছিল তৈলকুম্পি যা বর্তমানে তেলকুপি নামে পরিচিত। এই বংশের শেখর বা শিখর পদবী থেকেই রাজ্যের নাম হয় শিখরভূম।
🟠 মহারাজা রুদ্র শেখর 🟠
মহারাজা রুদ্র শেখর নামক একজন শিখর বংশীয় রাজার নাম পাওয়া যায় পাল সম্রাট গৌড়েশ্বর রামপাল এর আমলে সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত গ্রন্থে, তিনি তৈলকম্পা র সামন্ত ছিলেন এবং গৌড়েশ্বরের সঙ্গে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের যৌথ অভিযান করেন জানা যায়।
রামচরিত এ আছে:-
।। বন্দ্যগুণ–সিংহবিক্রম শুরশিখর-ভাস্করপ্রতাপৈ-স্তৈ।
স মহাবলৈ-রূপেতো জেতু জগতী-_মলচ্ভুষ্ণু।।
রামচরিতম:- ২|৫
অর্থাৎ তিনি (রামপাল) এইসব যোদ্ধৃবর্গের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে পৃথিবী বিজয়ের সামর্থ্য অর্জন করেছিলেন। এরা ছিলেন বন্দ্য ( ভীমষশ), গুণ (বীরগুণ), সিংহ (জয়সিংহ ), বিক্রম (বিক্রমরাজা), শূর (লক্ষ্মীশূর ), শিখর (রদ্রশিখর), ভাস্কর (মরগলাসহ) এবং প্রতাপ(প্রতাপ সিংহ)। এখানে গৌড়েশ্বর রামপাল এর সাথে শিখররাজ রুদ্র শিখর এর নাম নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও বলা আছে:-
” শিখর ইতি সমপরিসর
বিসরদ-অরিরাজ-রাজিগণ্ড গর্ব্ব-গহন দহন
দাবানলস-তৈলকম্পীয় কল্পতরূ, রুদ্র শিখর ”
এর থেকে আন্দাজ করা যায় মহারাজা রুদ্র শেখর অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী ছিলেন। তিনি দাবানলের ন্যায় বিরোধী রাজাদের জলে স্থলে ধ্বংস করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন দানী, সুশাসক; কল্পতরুর সাথে তাঁর তুলনা করা হয়। শ্রী নিহাররঞ্জন রায় মহাশয়ের মতে মহারাজা রুদ্র শেখর ১০৭০-১১২০ খ্রিস্টাব্দ রাজত্ব করেন।
🟠 মহারাজা কল্যাণ শেখর 🟠
মহারাজা কল্যাণ শেখর সম্ভবত ছিলেন রুদ্র শেখর এর পৌত্র অথবা প্রপৌত্র। তিনি ইতিহাসে বরাকর নদের তীরে অবস্থিত মা কল্যাণেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য এবং শিখরভূমের কুলদেবী মা রাজরাজেশ্বরী র প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচিত। তাঁর সময়কাল নিয়ে কিছু দ্বিমত আছে এবং তাঁর দুই দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়েও দুটি মত বর্তমান।
প্রথমটি হলো গৌড়েশ্বর বল্লালসেনের কন্যা কল্যাণীর সাথে মহারাজের বিবাহ হয় এবং যৌতুক স্বরূপ তিনি সেন বংশের মা শ্যামারূপার মূর্তি পান যা তিনি কল্যাণেশ্বরী মাতা রূপে প্রতিষ্ঠা করেন।
দ্বিতীয়টি হলো মহারাজ কল্যাণ শেখরের সাথে কাঁকসার রাজকন্যার বিবাহ হয় এবং সেখান থেকেই তিনি মা শ্যামারূপাকে পান ও পরবর্তীকালে কল্যাণেশ্বরী মাতা রূপে প্রতিষ্ঠা করেন।
আজ ও বরাকরের তীরে অবস্থিত মন্দিরে মা কল্যাণেশ্বরী পূজিতা হন এবং তিনি অত্যন্ত জাগ্রত। অন্যদিকে কাশীপুর রাজবাড়ীতে সাড়ম্বরে পূজিতা হন মা রাজরাজেশ্বরী, দুর্গাপূজায় পুজো হয় ষোলো দিন ধরে।
[ এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কাঞ্জিক এই প্রকাশিত বাংলায় দুর্গাপূজার ইতিহাস লেখাটি দেখুন:- https://kanjik.net/durga-puja-since-antiquity/]
🟠 মহারাজা দ্বিতীয় হরিশ্চন্দ্র শেখর 🟠
পুরুলিয়ার ইতিহাসে তিনজন হরিশ্চন্দ্র শেখর এর নাম পাওয়া যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। তাঁর মধ্যে মহারাজা দ্বিতীয় হরিশ্চন্দ্র শেখর দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা হন বলে জানা যায়। তিনি সম্ভবত উড়িষ্যার গঙ্গ বংশীয় রাজা অনঙ্গ ভীমের আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং এরপর গঙ্গা বংশের সাথে পঞ্চকোট এর মিত্রতা হয়। এদের মধ্যে একজন হরিশ্চন্দ্র বেগুনিয়া অঞ্চলে দুটি প্রখ্যাত দেউল পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণ করেন যা সিদ্ধেশ্বর দেউল নামে পরিচিত। এই দেউল এ প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় তিনি তাঁর স্ত্রী হরিপ্রিয়া দেবীর ইচ্ছায় এই দেউল নির্মাণ করেন।
🟠 মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর 🟠
মহারাজা হরিশ্চন্দ্র শেখর এর সুপুত্র মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর ছিলেন শিখরভূমের অন্যতম মহান এবং পরাক্রমশালী নৃপতি। তাঁর আমলে শিখরভূম বিশাল অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। শিখরভূম রাজবংশ সেন সাম্রাজ্যের আমলেও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এর আমলে শিখরভূম রাঢ়ের অন্যতম বৃহত্তম শক্তি হয়ে উঠেছিল। তিনি ১২২১ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১২৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। প্রেম শেখর ও অর্জুন শেখর নামক তার দুই পুত্র ছিল।
মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এর রাজত্বকালে ই প্রথম রাঢ়বঙ্গে মুসলিম আক্রমণ ঘটে। ১২২৩ সালে গিয়াসউদ্দিন খিলজি তৃতীয় বারের চেষ্টায় ছল করে পশ্চিম সেন সাম্রাজ্যের রাজধানী রাজনগর বা লখনৌর দখল করে নেয়। গোরুর পালের শিং এ আগুন লাগিয়ে তাদের পিছন থেকে আক্রমণ করে মুসলিম সেনা,হিন্দুরা গোহত্যা করেনা তাই কোন প্রতিরোধ হয়নি। গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন এর পৌত্র মহারাজা বীরসেন এরপর রাজধানী চন্দ্রপাহাড়িতে স্থানান্তর করেন
সেনাপতি হিসেবে বিশ্বম্ভর শেখর পেয়েছিলেন সামন্তভূমের শাসক মহাবীর প্রথম হামীর রায় কে, যিনি তুর্কি লেখনীতে সামন্ত রায় বা সাবন্ত রায় নামে পরিচিত। উত্তর হামীর রায় ছিলেন উড়িষ্যায় রাজত্বকারী গঙ্গ বংশের জামাতা।
🛑 শিখরভূম জোট ও রাজনগরের যুদ্ধ 🛑
১২২৩ থেকে খিলজির দখলে থাকা রাজনগর কে যবনমুক্ত করে সেখানে সনাতনী বিজয় পতাকা উত্তোলন করার পরিকল্পনা করেন মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর ও প্রথম হামীর রায়। পরিকল্পনা সফল করার উদ্দেশ্যে রাঢ় ও বঙ্গভূমের শাসকদের একত্রিত করার উদ্যোগ নেন তাঁরা। আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হন বঙ্গভূম তথা পূর্ব সেন সাম্রাজ্যের প্রবলপরাক্রমী শাসক মহারাজাধিরাজ বিশ্বরূপ সেন, মল্লভূমের শাসক মহারাজা ভীম মল্ল, গোপভূমের শাসক মহারাজা শতক্রুত সিংহ, চন্দ্র পাহাড়ি তথা পশ্চিম সেন রাজ্যের শাসক মহারাজা বীরসেন। মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এর সভাপতিত্বে স্বীকৃত হয় রাজনগর পুনর্দখল এর কথা। ১২৪৪ সালে গঠিত হয় ” শিখরভূম জোট ” উড়িষ্যার রাজা নরসিংহ দেব এই জোটে অংশগ্রহণ করেন বলে জানা যায়।
বিজয়া দশমীর দিন হামীর এর নেতৃত্বে এগিয়ে যায় মহাবলী সংযুক্ত সেনাবাহিনী। রাঢ়ীয় অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়ার খুরে লাল মাটির ঝড় ওঠে, অস্ত্রের ঝংকারে চোখ ঝলসে যায়। বিশাল রণোন্মদ সেনাবাহিনীর রণধ্বনিতে আকাশ মুখরিত হয়; করালরূপী বাহিনী এগিয়ে চলে যবন নিধন করতে।
মহাবীর হামীর এর নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু হয়। যবনরক্তে লাল হয়ে ওঠে অস্ত্র। সম্মিলিত সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড ক্ষমতার সামনে পরাস্ত হতে হয় যবন দের। মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এর নেতৃত্বে বিজয়ী বাহিনী প্রবেশ করে রাজনগর দুর্গে, আবার সনাতনী শাসনভুক্ত হয় দুর্গ।
বীর হামীর কে লখনৌর দুর্গ দায়িত্ব দেন মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর। এরপর ১২৪৮ সালে ইজ উদ্দিন খিলজি মঙ্গলকোট দিগনগর থেকে রাজনগর কোটাসুর অবধি সমস্ত বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দেয় যাতে মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর বাধ্য হন লখনৌর দুর্গ ছেড়ে দিতে।
কিন্তু মহাবলী রাঢ়ীয় সেনা আবার জেগে ওঠে যবন নিধন করতে। হামীর এর নেতৃত্বে শিখরভূম সেনা ও রাজা ভীম মল্ল এর নেতৃত্বে মল্ল সেনা একত্রিতভাবে আক্রমণ করে ও যবন নিধন করে। ইজ উদ্দিন এর পরাজয় ঘটে, এসময়ে তামুর খান খিলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ইজ উদ্দিন এর জায়গায় তামুর খান পরবর্তী প্রশাসক হয়।
১২৫২ অবধি মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর রাজত্ব করেন, তারপর তাঁর পুত্র প্রেম শেখর রাজা হন। ইতিহাস বিশ্বম্ভর শেখর কে শিখরভূম তথা রাঢ়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি হিসেবে স্মরণে রাখবে।
🟠 মহারাজা প্রেম শেখর 🟠
মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এর জেষ্ঠ্য পুত্র প্রেম শেখর তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়েও প্রথম হামীর শিখরভূমের সেনাপতি ছিলেন।
🛑কাটাসিংগার যুদ্ধ 🛑
১২৫৮ সালে মুগিসউদ্দিন রুজবক বীরভূমের কোটাসুর শহরের কাটাসিংগা গড় দখলের পরিকল্পনা করে যা শিখরভূমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রেম শেখর এর বাহিনী আবারও হামীরের নেতৃত্বে এগিয়ে যায়। তাঁর সাথ দেন গঙ্গবংশীয় নৃপতি নরসিংহ দেব ও মহারাজা ভীম মল্ল। হিন্দু যোদ্ধারা দুর্গের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এবং বাইরে তিনটি খাল খনন করে রাখা হয়, তার সাথে কিছু হাতী ও খাদ্যশস্য রেখে দেওয়া হয়। রুজবকের নেতৃত্বে প্রায় ৬৫০০০ সেনা এসে হাতী ও শস্য গুলি দখল করে নেয়, তারা ভাবে যুদ্ধ শেষ, তারা বিজয়ী হয়েছে। এই অবস্থায় তুর্কিরা মদ্যপান ও হুল্লোড় এ মেতে ওঠে।
এই অবস্থায় ২০০ পদাতিক ও ৫০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে হিন্দু সৈন্যরা জঙ্গলের মধ্যে থেকে তুর্কিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকা ও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত তুর্কিরা কোন সময় পায়না লড়াই করার। রাঢ়ীয় যোদ্ধাদের তরোয়াল যবন রক্তে লাল হয়ে ওঠে। এই সময়ে দুর্গের ভিতর থেকে আরো সৈন্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে যবন দের ওপর, ভীতসন্ত্রস্ত তুর্কিরা সব ছেড়ে পালাতে থাকে এবং অধিকাংশ ই মারা পড়ে।
মাত্র ২৫০ সৈন্য নিয়ে ৬৫০০০ যবন দমনের এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তুর্কিরা পালিয়ে নাগর অঞ্চলে চলে আসে। সেখানেও শিখর মল্ল গঙ্গ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়।
এর কিছু কাল পরে মুসলিম বাহিনী দুইদিক থেকে লখনৌর আক্রমণ করে। মন্দার এবং কাটাসিংগা দুই দিক থেকে এসে লখনৌর কে ঘিরে ফেলা হয়। এসময় হামীর রায় গোপনে নিহত হন। হামীরের মৃত্যুর পর লখনৌর যবন দের অধিকারে চলে আসে দুর্ভাগ্যবশত।
মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর ও মহারাজা প্রেম শেখর এর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস ধোঁয়াচ্ছন্ন… বিভিন্ন রাজাদের নাম কুলজি থেকে পাওয়া গেলেও তাদের ব্যাপারে বিশদ জানা যায় না। তবে তাঁরা যে নিজ রাজ্য রক্ষা করেছিলেন তা বলা যায়।
লখনৌর এ একত্রিত আক্রমণের ১৫০ বছর পর আবার ও একটি একত্রিত আক্রমণ পরিকল্পিত হয়েছিল যবনদের বিরুদ্ধে।
🟠 মহারাজা দ্বিতীয় রামচন্দ্র/হরিনারায়ণ শেখর 🟠
মহারাজা দ্বিতীয় রামচন্দ্র শেখর ১৩৮৮ সালে “হরিনারায়ণ” উপাধি নিয়ে শিখরভূমের সিংহাসনে বসেন। সেই সময়ে বঙ্গ অঞ্চলে রাজত্ব করছেন দেববংশের শাসক শ্রীচণ্ডীচরণপরায়ন মহারাজা মহেন্দ্র দেব। এই সময়েও সামন্তভূম (ছাতনা) শিখরভূমের সামন্ত রাজ্য রূপে ছিল।এই সময়ে প্রখ্যাত পণ্ডিত পদ্মনাভ শিখরভূমের সভাপণ্ডিত ছিলেন।
মনে করা হয় এই সময় শিখরভূম ও দেব বংশের একত্রিত হয়ে একটি যুদ্ধ করেছিল। কুলজি থেকে কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও সমকালীন অন্যান্য তথ্যসূত্র এই ঘটনার প্রমাণ দেয়।
ষড় গোস্বামীর অন্যতম প্রভুপাদ জীবগোস্বামীর লেখা থেকে জানা যায়:-
“বিহার গুণিশেখরঃ শিখরভূমি বাসস্পৃহাৎ স্ফুবৎসুবতরঙ্গিনী — তটীনবাস পর্যৎসুকঃ ॥
ততো দনুজমর্দন ক্ষিতি পুজ্যপাদঃ ক্রমা
দুবাস নবহট্টকে স কিল পদ্মনাভ কৃতীঃ ॥”‘
– লঘু বৈষ্ণবতোষণী অর্থাৎ রাজা দনুজমর্দন যার পাদপুজা করতেন, সেই গুনীশ্রেষ্ঠ কৃতী পদ্মনাভ শিখরভূমি বাসের স্পৃহা পরিত্যাগ করে গঙ্গাতীরে বাস করতে নবহট্টকে (নৈহাটিতে) বসতি করেছিলেন।
লেখক জীবগোস্বামীর প্রপিতামহ যিনি শিখরভূম রাজসভায় সভাপন্ডিত ছিলেন তিনি নবহট্টে চলে আসেন। পদ্মনাভ শিখরভূমের রাজ পণ্ডিত ছিলেন, মহেন্দ্রদেব এর সভায় তাঁর গমন দেব রাজ্য ও শিখরভূমের মধ্যের সুসম্পর্কের পরিচয় দেয়।
🛑 নবহট্ট পুনর্দখল 🛑
মনে করা হয় চতুর্দশ শতকের শেষ কোন এক সময়কালে দনুজমর্দন দেব(মহেন্দ্র দেব এর পুত্র)এর নেতৃত্বাধীন দেব সৈন্য ও শিখরভূমের সৈন্য একত্রিত ভাবে সুলতানদের আক্রমণ করে পরাজিত করেন এবং মহেন্দ্র দেব নবহট্টে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন যেখানে পদ্মনাভ যান।
এই যুদ্ধে শিখরভূমের সামন্ত ছাতনার রাজকুমার হাম্বীর রায় (সামন্তভূমের রাজা দ্বিতীয় হামীর রায় এর পুত্র) শিখর-দেব জোটের হয়ে সেনাপতিত্ব করেন। ১৩৭৩-১৪০৪ এর মধ্যে সময়ে দেবকুলতিলক দনুজমর্দন দেব এর বাহিনী ও হাম্বীর রায় এর নেতৃত্বাধীন শিখরভূম বাহিনী একত্রিত হয়ে নবহট্টে আক্রমণ করে। জলপথে পূর্বদিক থেকে দেববংশের বিশাল নৌবাহিনী ও পশ্চিম থেকে রাঢ়ীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একত্রিত দ্বিমুখী আক্রমণের ফলস্বরূপ নবহট্টে সুলতানি শাসনের পতন ঘটে এবং দেববংশের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়। নবহট্টে দেববংশের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপিত হয়। এরপরে শিখরভূমের রাজা হরিনারায়ণ শেখর ও সভাপণ্ডিত শ্রী পদ্মনাভ হাম্বীর রায় এর রাজ্যাভিষেক করেন। পরবর্তীতে আচার্য পদ্মনাভ দনুজমর্দন দেব এর অনুরোধে নবহট্টে গিয়ে সেই সভা অলঙ্কৃত করেন।
দেববংশের পতন পরবর্তীকালে ও দীর্ঘ চার শতক ধরে শিখরভূম পঞ্চকোট এর রাজাদের রাজত্ব বর্তমান ছিল। ইসলামী শাসন একসময় পঞ্চকোটের আশেপাশের অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। এই সময় শমস খানকে হারিয়ে শিখরভূম রাজ্য মল্লভূমের বীর হাম্বীর মল্ল এর শাসনে চলে এলেও পরে আবার স্বাধীন ও হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এরপর বাংলার বুকে বর্গী আক্রমণ হয়।
🟠 মহারাজা প্রথম গরুড়নারায়ণ সিংহ দেব / শত্রুঘ্ন শেখর 🟠
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখর পঞ্চকোটের সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রথম গরুড়নারায়ণ সিংহ উপাধি ধারণ করেন, মাথায় জটা থাকায় তিনি জইট্যা গরুড়নারায়ণ নামে পরিচিত ছিলেন মানুষের কাছে। তিনি এক বিস্তৃত অঞ্চলে শাসন করতেন বলে মোগল নথি থেকে জানা যায়।
🛑বর্গী আক্রমণ প্রতিরোধ🛑
১৭৪১ সালে বাংলায় বর্গী আক্রমণ হয়। রামগড় হয়ে প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিত পঞ্চকোট এ উপস্থিত হয় এবং প্রচুর পরিমাণে লুটপাট করে।
গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণ এ লিখেছেন:- ” গ্রাম উপবন কত লস্কর এড়াএ ঘত লাগপুর অসি উপাঁনত। সেখানে ছাড়িয়া জবে লদ্কর মাইলা তবে পঞ্চকোটে আসিলা তারিত। “
বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে রাজত্ব থাকলেও শিখরভূম সেনাবাহিনী তার প্রাক্তন ক্ষমতা হারিয়েছিল। মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখর তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষরক্ষা হয়নি। পঞ্চকোট দুর্গ এবং আশপাশের বহু মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মহারাজা গরুড়নারায়ণ সিংহ এরপর রাজধানী কেশরগড়ে স্থানান্তরিত করেন।
বর্গীদের হাতে নিজ রাজধানী ধ্বংস হবার পাল্টা জবাব শিখরভূম রাজ দিয়েছিলেন শেরগড় পরগণা(অধুনা আসানসোল) এ। মল্লভূমে পরাজয়ের পর বর্গী বাহিনীর একটি দল ভাস্কর পণ্ডিতের সেনাপতি মোহন গিরির নেতৃত্বে গোপভূম সেনভূম অঞ্চল দিয়ে লুটপাট ও ধ্বংস করতে করতে বিহারের দিকে চলে যাচ্ছিল। এইসময় বর্গীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলেন গোপভূমের রাজা বৈদ্যনাথ রায়(বিস্তারিত তথ্যের জন্য গোপভূম অংশ দ্রষ্টব্য)।
রাজা বৈদ্যনাথ এর সঙ্গে যোগ দেন মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখর এর শেরগড় পরগণার দুই উগ্রক্ষত্রিয় সামন্ত নকড়ি রায় ও রামকৃষ্ণ রায়। শিখরভূমের বাহিনী এগিয়ে আসে সাহায্য করতে, সম্মিলিত শিখর-গোপ বাহিনী শেরগড় এর জঙ্গল অঞ্চলে ত্রিমুখী আক্রমণ করে বর্গীদের, যুদ্ধে শত্রু শোণিতে লাল হয়ে ওঠে রাঢ়ের লালমাটি। যুদ্ধে মোহন গিরির ভবলীলা সাঙ্গ হয়, বীরগতিপ্রাপ্ত হন রাজা বৈদ্যনাথ।
নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায় এর বীরত্বের জন্য তাঁদের শেরগড় অঞ্চলের জমিদারি দেন মহারাজা গরুড়নারায়ণ ৩৭৬।২ (তিন শত ছিয়াত্তর টাকা চার আনা দুই পাই) জমায়। এই অঞ্চল ই আজ আসানসোল শহর।
মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখর চারবার বিবাহ করেন এবং তাঁর মোট বারোজন পুত্র ছিলেন। তাঁর জীবৎকালেই জৈষ্ঠ্য পুত্র ভীমলাল মারা যান, গরুড়নারায়ণ এর মৃত্যুর পর তাঁর বড়নাতি মণিলাল রাজা হন।
🟠 মহারাজা নীলমণি সিংহ দেব🟠
মহারাজা নীলমণি সিংহ ছিলেন শিখরভূম (পঞ্চকোট বা কাশীপুর রাজ) এর সুযোগ্য ও গণ্যমান্য রাজা। যবন থেকে বর্গী সমস্ত আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছেন শিখররাজা রা, নীলমণি সিংহ তাঁদের যোগ্য বংশধর। একাধারে মহাবীর, বিদ্যোৎসাহী ,দয়ালু, প্রজাদরদী এবং ধর্মপরায়ণ নীলমণি সিংহ র ১৮২৩ সালে কেশবগড়ে জন্ম হয়। পরে কাশীপুরে নূতন রাজভবন তৈরি হলে ১৮৩২ সালে সেখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮৪১ সাল থেকে তিনি জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা শুরু করেন এবং পিতা দ্বিতীয় গরুড়নারায়ণের মৃত্যুর পর ১৮৫১ সালে তিনি সিংহাসনে বসেন।
🛑 ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ 🛑
স্বাধীনচেতা মহারাজা নীলমণি সিংহদেব কোনদিনই ব্রিটিশদের মেনে নেননি। তাই সাঁওতাল প্রজাদের সাথে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। সাল ১৮৫৭। সিপাহি বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। ব্যারাকপুর থেকে এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পুরুলিয়া মানভূম অঞ্চলে। রাকাব অঞ্চলে বাগদি এবং সাঁওতালরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ১৮৫৭ সালের ৫ আগস্ট, বাংলা ২২ শ্রাবণ রাকা এলাকার প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল রাকাব জঙ্গলে সমবেত হয়ে ব্রিটিশ রাজত্বকে উৎখাত করার শপথ নিয়েছিলেন। ওই এলাকার কিংবদন্তী হল- শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল রাকাব জঙ্গলের রাকাববুড়ি অর্থাৎ বনদেবীকে সাক্ষী রেখে। সাঁওতালি ভাষায় রাকাব মানে ওঠানো বা তাড়ানো। এই বিশাল সাঁওতাল বাহিনীকে বন্দুক, কামান, অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে তাদের নেতৃত্ব দেন রাজা নীলমণি সিংহ দেব।
পুরুলিয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ওকসের বিবরণ থেকে জানা যায় মহারাজা বিদ্রোহীদের সাথে অস্ত্র নিয়ে যোগ দেন। ভীত ক্যাপ্টেন ওকস রাণীগঞ্জ পালিয়ে যায়। মহারাজা নীলমণি সিংহ র নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা পুরুলিয়ার ট্রেজারি লুঠ করে। ইংরেজদের জেল ভেঙে আসামিদের মুক্ত করা হয়। ৬৩ দিন এই সময় পুরুলিয়া ব্রিটিশ শাসন মুক্ত ছিলো।
অধিকাংশ বিদ্রোহী এরপর রামপুর অঞ্চলের দিকে লড়তে চলে যায় এবং এই সুযোগে ইংরেজরা কাশীপুর আক্রমণ করে, জয়চণ্ডী পাহাড়ের কাছে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও লোকবলের অভাবে এবং পিছন থেকে আক্রমণের জন্য নীলমণি সিংহ হেরে যান এবং বন্দি হন। ইংরেজ সরকার কাশীপুর রাজ নিলামের চেষ্টা করলে সাঁওতালরা তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে, শেষে নিলাম বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহারাজা নীলমণি সিংহ দেও কে প্রথমে শান্তিপুর পরে প্রেসিডেন্সি জেল এ নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮৫৯ সালের মার্চ অবধি তিনি বন্দি ছিলেন। কাশীমবাজারের রাণী স্বর্ণময়ী দেবীর সাহায্যে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
কলকাতায় বন্দিকালে দেবেন্দ্রমোহন ঠাকুর ও মধুসূদন দত্ত র সাথে নীলমণি সিংহ র পরিচিতি গড়ে ওঠে। তিনি মুক্ত হবার পর কিছু দিন মধুসূদন দত্ত কাশীপুর সেরেস্তায় কাজ করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে ছটি সেনেট ও রচনা করেন। নীলমণি সিংহ সাহিত্য সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি কাশীপুর কে ” দ্বিতীয় নবদ্বীপ ” রূপে গড়ে তোলেন। প্রখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী যদুভট্ট ও তাঁর পিতা কাশীপুর রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন। কাশীপুরের ” মা রাজরাজেশ্বরী ” র মন্দির তিনি তৈরি করেন। কাশীপুরের বর্তমান রাজপ্রাসাদ নীলমণি সিংহ দেব এর নাতি রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেব এর সময়ে তৈরি হয়। কাশীপুর রাজবাড়িতে আজও এই বংশের উত্তরাধিকারীরা আছেন।
🔶 গোপভূম রাজ্য 🔶
” গোপভূম নামে দেশ অতিপুরাতন।
কত গোপ বাস করে শুন দিয়া মন।।
অজয় কুনুর বহে গোপভূম ভিতর ।
এর মাঝে আছে কত সুন্দর শহর।।
ভালকী উজানী ভাদর দিগনগর।
উননাগ মঙ্গলকোট ভালকী শহর ।।
বানকেশ্বর ভরতপুর বসুধা চুরুলিয়া
পনিয় সুয়াতা আর জাঙ্গলে বেড়িয়া ।।
গোপভূম রাজ্যে আছে এসব নগরী।
জঙ্গলেতে ঘেরা দেশ অপরূপ পুরী ।। “
রাঢ়ের দ্বাদশ ভূমের অন্যতম প্রধান এবং শক্তিশালী ছিল গোপভূম। দামোদর ও অজয়ের মধ্যবর্তী অধুনা সম্পূর্ণ পশ্চিম বর্ধমান জেলা, পূর্ব বর্ধমানের গলসী অবধি এবং বীরভূমের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল ছিল গোপ ও সদগোপ জাতির মানুষদের বাসস্থান ছিল, সেখান থেকেই গোপভূম নামকরণ। রাঢ়ীয় সদগোপরা অত্যন্ত বীর জাতি, সমস্ত আক্রমণকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে প্রবলভাবে। এই অংশে আমরা গোপভূমির দুটি রাজ্য ভাল্কি এবং কাঁকসার কথা বলবো।
🟠 মহারাজা রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ 🟠
গোপভূমের ভাল্কি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহারাজা রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ।
বংশকুলজি অনুসারে জনৈক ক্ষত্রিয় রাজার পুত্র ছিলেন তিনি। ৪৪২ বঙ্গাব্দে মাঘ মাসে সরযূতীরের এক রাজা গঙ্গাসাগর দর্শন করতে যাচ্ছিলেন তার গর্ভবতী স্ত্রী কে নিয়ে, সেই সময় পশ্চিম বর্ধমানের মানকর অঞ্চলে সেই স্ত্রী একটি সন্তান প্রসব করে। এই সন্তানকে মৃত ভেবে চলে যান সেই রাজা।
সেই সন্তান কে একজন ভল্লুকী স্তনদুগ্ধ পান করায় এবং রক্ষা করে। এই ভল্লুকী রক্ষিত শিশুটিকে রাজলক্ষণযুক্ত বুঝতে পেরে একজন ঋষি নিয়ে আসেন এবং বড় করেন। ভল্লুকী দ্বারা রক্ষিত বলে তাঁর নাম হয় ভল্লুপাদ। মতান্তরে ভল্লুকের মত শক্তিশালী ও বিশালদেহী বলে এই নামকরণ।
গোপভূমের সভাকবি ( রাজা বৈদ্যনাথের কালে ) দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখিত শিবাখ্যাকিঙ্কর কাব্যে ভল্লুপাদের বংশ পরিচয় প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে—
ভল্লুপাদ নাম জানে সর্বজন ।
ভালুকে তাহারে করিল পালন।
জাতীয় প্রকৃতি লুকাবার নয়
শৈশবে সে শিশু নিৰ্ভয় হৃদয়।
মৃগয়া করিত শ্বাপদ বধিত
বনের বরাহ করিয়া বিজয়।
ঋষির শিক্ষায় রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ বড় হতে থাকেন এবং ক্রমে অদ্বিতীয় বিদ্বান ও বীর হয়ে ওঠেন।
যুবক হয়ে রাঘব একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভাল্কি রাজ্য স্থাপন করেন। রাঘব সিংহ এর সাথে নীলপুরের ঘোষ বংশের মহাত্মা কালু ঘোষের কন্যার বিবাহ হয়। রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ প্রতিষ্ঠিত বংশ প্রায় ছয় দশক স্বাধীনভাবে রাজত্ব করে।
রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ বোলপুরের বিখ্যাত দুগ্ধেশ্বর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়।
🟠মহারাজা গোপাল সিংহ ও মহারাজা শতক্রুত সিংহ🟠
রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ এর পর গোপভূমের কুলজি থেকে গোপাল সিংহ এবং শতক্রুত সিংহ নামক দুই রাজন্যের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কে রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ এর পুত্র এবং কে পৌত্র সেই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। শতক্রুত সিংহ একশত যজ্ঞ আয়োজন করেন বলে জানা যায়। এই দুই রাজার রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভূমিতে প্রথম ইসলামী আক্রমণ হয়।
🛑কাঁকসার যুদ্ধ 🛑
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি তার বাহিনী নিয়ে রাজমহল পাহাড় দিয়ে এসে গোপভূমের ভাল্কির পার্শ্ববর্তী মিত্র রাজ্য কাঁকসায় আক্রমণ করে। এইসময় কাঁকসার সিংহাসনে আসীন ছিলেন মহারাজা কঙ্ক সেনরায়। যুবরাজ কনক সেনরায় কুলদেবতা কঙ্কেশ্বর মহাদেব এর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে খিলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। তাঁর বীরত্বের সামনে খিলজির সেনাপতি টিকতে পারেনি, সৈয়দ বোখারীর ভবলীলা সাঙ্গ করেন যুবরাজ।
কিন্তু ধূর্ত খিলজি এইসময় আরেক দল বাহিনী নিয়ে কাঁকসাগড় আক্রমণ করে, বৃদ্ধ মহারাজা কঙ্ক সেনরায় প্রতিরোধ করতে গিয়ে বীরগতি প্রাপ্ত হন। কাঁকসা গড় এবং কঙ্কেশ্বর মহাদেব এর মন্দির ধূলিসাৎ করে দেয় ইসলামী বাহিনী। কনক সেনরায় চেষ্টা করেও রাজ্যকে রক্ষা করতে না পেরে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী মিত্র রাজ্য ভাল্কিতে।
🛑 শিখরভূম জোটে যোগদান 🛑
১২৪৪ সালে বীরভূমের রাজনগর দূর্গ পুনরুদ্ধার এর উদ্দেশ্য তৈরি “শিখরভূম জোট” এ গোপভূম রাজ ও যোগ দিয়েছিলেন [ বিস্তারিত জানতে শিখরভূম অংশ দ্রষ্টব্য]
🟠 মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ 🟠
গোপভূমের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী নৃপতি, সদগোপকুলতিলক, অপরাজেয় মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ চতুর্দশ শতাব্দীতে সিংহাসনে আরোহণ করেন। মহেন্দ্র সিংহ র সময় গোপভূম উত্তর রাঢ়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দু রাজ্য ছিল, তিনি সফলভাবে বারবার ইসলামিক আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।
🛑 অমরারগড় নির্মাণ ও পরিবার:-
গোপভূম ভাল্কি রাজবংশের সন্তান মহেন্দ্র সিংহ ছিলেন সম্ভবত শতক্রুত সিংহের পুত্র বা পৌত্র, তাঁর মায়ের নাম ছিল রাজমাতা শিব্যা। যুবরাজ অবস্থায় মহেন্দ্র নীলপুরের রাজা কালীদাস ঘোষের কন্যা অমরাবতী কে বিবাহ করেন। অমরাবতীই ছিলেন মহেন্দ্র সিংহর প্রধান মহিষী, তাঁর ই নামে স্থাপন করেন অমরারগড় নামে দুর্গ, আজ দুর্গ অবশিষ্ট নেই কিন্তু গ্রামের নাম রয়ে গেছে অমরার গড়।
অমরাবতী ছাড়াও মহেন্দ্র সিংহ র দুইজন স্ত্রী ছিলেন:- বিষ্ণুপুরের রাজা বীরবরের কন্যা গৌরী ও অন্যজন কাঞ্চনকুমারী।
অমরাবতীর গর্ভে এক পুত্র যোগেন্দ্র এবং দুই কন্যা যমুনা ও কালিন্দীর জন্ম হয়। কাঞ্চনকুমারীর গর্ভের সন্তানরা দিগনগর অঞ্চলে জমিদারি স্থাপন করেন। মহেন্দ্র সিংহের প্রথম কন্যা যমুনার সাথে সদগোপ বীর শিবাদিত্য সিংহ রায় এর বিবাহ হয়। মহেন্দ্র নিজ জামাতাকে বীরভূমের সিহুরগড়(অধুনা সিউড়ি) এর রাজত্ব প্রদান করেন। দ্বিতীয় কন্যা কালিন্দীর সাথে কাঁকসার কনক সেন রায় এর পৌত্র/প্রপৌত্র প্রতাপাদিত্য সেন রায় এর সাথে বিবাহ হয়। মহেন্দ্র এই জামাতাকে কাঁকসা গড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
🛑 সেনাবাহিনী সংস্কার:-
মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ রাঢ়ীয় সদগোপ গোষ্ঠীপতিদের একত্রিত করে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। আশেপাশের অঞ্চলের বাগদী চণ্ডাল আগুরিরাও তাঁর সেনাবাহিনীর অংশ ছিলেন। মহেন্দ্র সিংহ এর সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্ব করতেন তাঁর ভাই অমরেন্দ্র সিংহ, পুত্র কুমার যোগেন্দ্র এবং দুই জামাতা শিবাদিত্য ও প্রতাপাদিত্য।
🛑 সাম্রাজ্য বিস্তার:-
মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ গোপভূম সাম্রাজ্যকে এক বিশাল অঞ্চলে বিস্তৃত করেন। সমগ্র বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান , পশ্চিম বর্ধমান পেরিয়ে পঞ্চকোটের সীমানা এবং অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড সীমানা অবধি বিস্তৃত ছিল তাঁর শাসন। নিজ সময়ের উত্তর রাঢ়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দু নৃপতি ছিলেন তিনি। সদগোপ কুলজি থেকে জানা যায় তিনি গৌড়েশ্বর কেশব সেন এর বংশোদ্ভূত বীরভূমে শাসনরত সেনবংশীয় শেষ স্বাধীন শাসক সুদর্শন সেন কে পরাজিত করেন। কাটোয়ার খেজুরডিহির ঊগ্রক্ষত্রিয় জমিদার জগতসিংহ কে পরাজিত করে মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ তাঁর পূজিত দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী মা শিবাখ্যা দেবীকে গোপভূম এ এনে প্রতিষ্ঠা করেন। মা শিবাখ্যা হয়ে ওঠেন গোপভূমের কুলদেবী।
[ মহেন্দ্র সিংহের সাম্রাজ্যের বিস্তার ]
(গোপভূমের মা শিবাখ্যা)
🛑সদগোপ কৌলীন্য প্রথা প্রচলন:-
গুরু শিবরাম এর আদেশে মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ সদগোপদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথা প্রচলন করেন বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে ভাল্কির বংশ অর্থাৎ তাঁর বংশ হয় প্রথম কুলীন, সিহুরগড় অর্থাৎ শিবাদিত্য সিংহ রায় এর বংশ হয় দ্বিতীয় কুলীন এবং কাঁকসাগড় অর্থাৎ প্রতাপাদিত্য সেন রায় এর বংশ হয় তৃতীয় কুলীন।
🛑 গড় নির্মাণ ও পুনরুদ্ধার:-
নিজ অঞ্চল সুরক্ষিত রাখতে ও ইসলামী আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মহেন্দ্র সিংহ সমগ্র গোপভূম এ অমরারগড়, কাঁকসাগড় ও সিহুরগড় ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে গড় নির্মাণ ও পুনরুদ্ধার করেন এবং সেখানে সৈন্য বসান। তালিতগড়, কোটশিমুলগড়, শক্তিগড়, ভাটাকুল রামচন্দ্রগড়, সেনপাহাড়ি গড়, নরপালগড়, শ্যামারূপাগড়, সমুদ্রগড়, পানাগড়, রাজগড়, চুরুলিয়া নরোত্তমগড়, দিশেরগড়, কালনাগড়, শাঁখাইগড় এদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও তাঁর রাজত্ব জুড়ে মহেন্দ্র সিংহ সেনাবাহিনীর নজর রাখার জন্য প্রহরীদুর্গ তৈরি করান। এই ধরনের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মাচান এখনও ভাল্কি অঞ্চলে রয়েছে।
[ গড়গুলির অবস্থান ]
🛑 ইসলামিক আক্রমণ প্রতিরোধ:-
চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লখনৌতির সিপাহসালার কাদার খান এবং সোনারগাঁও এর সিপাহসালার বাহরাম খান এর মধ্যে বিবাদ ও যুদ্ধ শুরু হয়। এই অবস্থায় মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ নিজ শক্তি প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি করে নেন।
⭕ বাহমান গাজীর আক্রমণ প্রতিরোধ:-
বাঙ্গালী নৃপতিদের প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রতিরোধ এর মুখে পড়ে দিল্লি সালতানাত সরাসরি যুদ্ধ না করে বিভিন্ন গাজীদের পাঠাতে থাকে ছলেবলে রাজ্য দখলের জন্য। ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কাঁকসায় এইধরনের এক পীর বা গাজী গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে প্রতাপাদিত্য সেন রায় এর হাতেহাতে এবং বন্দী হয়। এইসময় লখনৌতির সিপাহসালার ফকরুদ্দিন মুবারক বাহমান গাজী নামক এক যোদ্ধা করে পাঠায় ভাল্কি দখল করতে। গোপভূম বাহিনী প্রতাপাদিত্যের সেনাপতিত্বে গাজীর বাহিনীর সংহার করে এবং গাজীর ভবলীলা সাঙ্গ হয়। এই বাহমান গাজীরই একজন বংশধর মৃগাবতী কাব্য লিখেছিল হোসেন শাহের রাজসভায়।
⭕ সৈয়দ বর্মন এর আক্রমণ প্রতিরোধ:-
বাহমান গাজীর আক্রমণ প্রতিরোধ এর পর ভাল্কি রাজ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে সমস্ত দিক থেকে। ১৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে সিকন্দর শাহের সেনাপতি সৈয়দ বর্মন ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে গোপভূম আক্রমণের চেষ্টা করে। এইসময় মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ পুত্র যোগেন্দ্র র সাথে জামতাড়া অঞ্চলে সৈয়দ বর্মনের বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। প্রচণ্ড যুদ্ধে সৈয়দ বর্মনের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয় গোপভূম সেনা, যুদ্ধে সৈয়দ বর্মন মারা যায় নিজেও। বলাবাহুল্য এই ঘটনার পর সিকন্দর শাহ আর কোনদিন ভাল্কি আক্রমণের দুঃসাহস দেখায়নি।
মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ র রাজত্বকাল ছিল গোপভূমের ইতিহাসের সবথেকে গৌরবময় সময়কাল, বহিরাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি মা শিবাখ্যা মন্দির প্রতিষ্ঠা, দুগ্ধেশ্বর মন্দির সংস্কার এবং দুই কন্যার নামে দীঘি খনন করান। তাঁর কার্যের প্রমাণ স্বরূপ আজও মা শিবাখ্যা রয়েছেন এবং দুটি দীঘি ও বর্তমান।
মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ এর পর তাঁর পুত্র যোগেন্দ্র সিংহ(মতান্তরে নরেন্দ্র সিংহ), পৌত্র হরিশচন্দ্র(বা ধ্বজনারায়ণ) এবং প্রপৌত্র রণভীম সিংহ রাজা হন বলে কুলজি থেকে জানা যায়। দুর্ভাগ্যবশত এই কুলজির বেশ কিছু অংশ পোকায় কেটে ফেলায় পরবর্তী প্রায় আট নয় প্রজন্মের নাম জানা যায়নি। হোসেন শাহ সমসাময়িক রাজা গণেশ রায় এর নাম জানা যায় ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্য থেকে। গোপভূমের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন মহারাজা বৈদ্যনাথ রায়।
🟠 মহারাজা বৈদ্যনাথ রায় 🟠
মহারাজা বৈদ্যনাথ রায় গোপভূমের ভাল্কি বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজা ছিলেন বলে জানা যায়। এই সময়কাল ছিল বাংলার ইতিহাসের এক অভিশপ্ত সময়, ঘটেছিল বর্গী আক্রমণ। মহারাষ্ট্র পুরাণ থেকে জানা যায়, গোপভূম ও সেনভূম(কাঁকসা) র বিস্তীর্ণ অঞ্চল বর্গীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, প্রচুর পরিমাণে মন্দির ভাঙা হয় এবং বৈঁচি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় বর্গীরা।
মহারাজা বৈদ্যনাথ রায় তখন গোপভূমের শাসক। পূর্ব ক্ষমতা হারালেও বৈদ্যনাথ এর মধ্যে তাঁর পূর্বপুরুষদের ক্ষাত্রশক্তি ছিল। সামান্য কিছু সৈন্য নিয়েই তিনি বর্গীদের বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। শেরগড় পরগণা অর্থাৎ আসানসোল অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে মোহন গিরির নেতৃত্বে থাকা বর্গীদের ওপর আক্রমণ করে গোপভূমের সেনাবাহিনী। গোপভূমের সাথে যোগ দেন শিখরভূমের দুই উগ্রক্ষত্রিয় সামন্ত নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায়। গোপ শিখর জোটের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে ত্রিমুখী আক্রমণ প্রতিহত করতে অক্ষম হয় বর্গীরা। মোহন গিরি যুদ্ধে মারা যায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই বীরগতি প্রাপ্ত হন বীর বৈদ্যনাথ রায়।
রাজা বৈদ্যনাথ রায় এর রাজসভাতেই সভাকবি দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রখ্যাত শিবাখ্যাকিঙ্কর কাব্য রচনা করেন। দুর্ভাগ্যবশত কাব্যটির সম্পূর্ণ পুঁথি পাওয়া যায়নি, কেবলমাত্র কিছু অংশ সংরক্ষিত হয়েছে। এই চট্টোপাধ্যায় বংশই জমিদারি পেয়েছিলেন অধুনা দুর্গাপুর অঞ্চল জুড়ে এবং এই বংশেরই দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায় থেকে জমি কিনে দুর্গাপুর শহর ও ইস্পাত কারখানা তৈরি হয়েছিল।
🟠 রাজা মহেন্দ্র রায়(দ্বিতীয় মহেন্দ্র) 🟠
গোপভূমের শেষ শাসক ছিলেন রাজা মহেন্দ্র রায়, যিনি দ্বিতীয় মহেন্দ্র নামেও পরিচিত। মহেন্দ্র সম্ভবত বৈদ্যনাথ রায় এর ভাই ছিলেন। দ্বিতীয় মহেন্দ্র খুব ই কম সময় রাজত্ব করেন।
দ্বিতীয় মহেন্দ্রর রাজত্বকালে আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌলা নবাব হয়। লম্পট সিরাজের অসভ্যতা, অত্যাচার এবং নারীলোলুপতা অসহ্য হয়ে উঠছিল সকলের পক্ষেই। এইসময় বাংলার অধিকাংশ হিন্দু রাজন্য একত্রিত হন সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে। নবদ্বীপের কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রাজা রামনারায়ণ রায়, রাজা দ্বিতীয় মহেন্দ্র রায় প্রমুখ রাজারা একটি সভায় একত্রিত হন।
এরপর দ্বিতীয় মহেন্দ্র রায় এর উপর আক্রমণ করে নবাব তাবেদার বর্ধমানের খত্রি রাজা চিত্রসেন রায়। বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মহেন্দ্র দ্বিতীয় বীরের ন্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন এবং গোপভূম রাজ্যের পতন হয়। বিস্তীর্ণ অঞ্চল যুক্ত হয় বর্ধমান রাজের শাসনে। গোপভূমের বংশধররা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন শুরু করেন।
গোপভূম রাজবংশের প্রতীক ছিল ভাল্লুক, এঁরা ভাল্লুকদের অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং ঐ অঞ্চলের জঙ্গলে যতদিন ভাল্লুক ছিল, ওনারা ভাল্লুক মারা পড়লে অশৌচ অবধি পালন করতেন বলে জানা যায়। আজ ভাল্লুক না থাকলেও ভাল্কি, ভাল্লুকশোল জাতীয় নাম রয়েই গেছে। এই বংশের বংশধররা আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এই অঞ্চলে, আজও তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন মা শিবাখ্যার আরাধনা। ভাল্কি অঞ্চলে বিভিন্ন দীঘি, এবং ভাঙাচোরা দাঁড়িয়ে থাকা কিছু অবয়ব আজও প্রমাণ দেয় এই বংশের গৌরবময় সময়কালের।
🔶সামন্তভূম রাজ্য🔶
সামন্তভূম বা ছাতনা ছিল বাঁকুড়ার একটি হিন্দু রাজ্য। আকারে ছোট হলেও এই রাজ্যের নৃপতিগণ বিভিন্ন সময়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন যবন আক্রমণের বিরুদ্ধে। এই বংশের রাজারা ক্ষত্রিয় ছিলেন, ক্ষত্রিয়ের অপভ্রংশ ছত্রি এবং ছত্রিদের বসবাসস্থল বলে ছত্রিনা বা ছাতনা বলে পরিচিত ছিল; আবার জেডি বেগলার সাহেব বলেছেন ছাতিম গাছ থেকে ছাতনা নামকরণ। এই রাজ্যের ইতিহাসে আমরা মোট তিনজন রাজার উল্লেখ পাই যাঁরা হম্মীর বা হামীর উপাধি ধারণ করেছিলেন।
সামন্তভূমের প্রথম রাজা ছিলেন শঙ্খ রায়, তাঁকে শিখরভূমের রাজা যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং ছাতনা পরবর্তী প্রায় সম্পূর্ণ সময় ই শিখর বংশের সামন্ত রাজ্য ছিল।
🟠 প্রথম হামীর রায় 🟠
সামন্তভূম এর ইতিহাসে প্রথম হামীর রায় এর নাম পাওয়া যায়। ইনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজা ছিলেন এবং শিখরভূমের মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখর এবং প্রেম শেখরের সামন্ত ছিলেন। তুর্কি ইতিহাসে ( তওকৎ ই নাসিরি) এনাকে সাবন্ত রায় বা সামন্ত রায় বলা হয়েছে। বিদ্যাধর রচিত একাবলী গ্রন্থে এনাকে হম্মীররাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম হামীর উড়িষ্যার রাজা নরসিংহ দেব এর জামাতা ছিলেন।
হামীর মহারাজা বিশ্বম্ভর শেখরের রাজত্বকালে শিখরভূম জোট তৈরি করেন এবং রাঢ়ীয় নৃপতিগণকে একত্রিত করে রাজনগর দুর্গ পুনর্দখল করেন এবং পরপর তিনটি যুদ্ধে যবনদের ধূলিসাৎ করে দেন।
[বিস্তারিত জানতে এই লেখার শিখরভূম রাজ্যের বিশ্বম্ভর শেখর ও প্রেম শেখর অংশ দ্রষ্টব্য]
🟠 উত্তর হামীর রায় 🟠
রাজা উত্তর হামীর রায় সামন্তভূমের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নৃপতি, তিনি এই বংশের কুলদেবী মা বাসলী দেবীর পূজা প্রচলন করার জন্য প্রখ্যাত।
শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের প্রদত্ত ছাতনা রাজবংশপরিচয়ে পাওয়া যায়:-
মাসাব্ধি বিশিখ শকে হামির উত্তর লোকে
সামস্তের কন্যা দিয়া রাজ্য দিল দান।
তাহারি সৌভাগ্যক্রমে বাসলী সামস্তভূমে
শিলামূর্তি ধরিয়া হলেন অধিষ্ঠান ।
পাষণ্ড দলন হেতু ভবাব্ধি তরণে সেতু
রচে যবে চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণলীলা ।
বিদ্যাপতি তদুত্তরে গাইল মিথিলাপুরে
হরিপ্রেম রসগীতি নাহি যার তুলা ।
ব্রহ্মা কাল কৰ্ণ (কর্ম) অরি শকে সিংহাসনোপরি
বসে বীর হাম্বির সে হামিরনন্দন ।
সংগ্রামে যবনে তাড়ি বঙ্গরাজ্য নিল কাড়ি
অভিষেক দিল তার জনৈক ব্রাহ্মণ ।
“মাসাব্ধি বিশিখ” বা ১২৭৫ শকে বা ১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে হামির উত্তর ছাতনার রাজা হন। তিনি “ব্রহ্ম কাল কর্ণ অরি” অর্থাৎ ১৩২৬ শকাব্দে বা ১৪০৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এই হামির উত্তরের রাজত্বকালে ছাতনায় বড়ু চণ্ডীদাস জীবিত ছিলেন।
এছাড়াও পদ্মলোচন শর্মার লিখিত বাসলী মাহাত্ম্য পুঁথি থেকে পাওয়া যায়:-
“ধন্যঃ সোহবনীমগবণে নবববঃ শ্রীহামীরশ্চোত্তরঃ।”
এবং
“ধ্বত্বিকবংশে বিলুপ্তে ষজন-ভজনরোহনিমালোক্য রাজা/শ্রীহামীরোত্তোরাখ্যো নিপততি সভয়ং মন্দিরান্তঃ প্রবিশা।।”
উপরোক্ত দুই লেখা পড়লে বোঝা যায় বাসলী মাতার মন্দিরের শিলালিপিতে উল্লিখিত উত্তররায় বা উতররায় ই হামীর উত্তর নামে পরিচিত এবং সামন্তভূমের কুলদেবী মা বাসলীর পূজা প্রচলন করেন। কিংবদন্তি অনুসারে তিনিই পুরোহিত হিসেবে দেবীদাস এবং সাহায্যকারী হিসেবে অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস কে নিয়ে আসেন।
[ মা বাসলী]
উত্তর হামীর এর পুত্র হাম্বীর রায় বঙ্গরাজ্যে যবন দমন করেন বলা হয়েছে। তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে দনুজমর্দন দেব এর নেতৃত্বাধীন দেব বাহিনীর সাথে একত্রিত ভাবে শিখরবাহিনীর সেনাপতিত্ব করেন এবং নবহট্ট পুনর্দখল করেন। তাঁর পিতার পর জনৈক ব্রাহ্মণ (সম্ভবত আচার্য পদ্মনাভ) তাঁর রাজ্যাভিষেক করেন।
[বিস্তারিত জানতে এই লেখার শিখরভূম রাজ্যের মহারাজা দ্বিতীয় হরিনারায়ণ শেখর অংশ দ্রষ্টব্য]
🟠 তৃতীয় হামীর রায় 🟠
সামন্তভূমের শেষ উল্লেখযোগ্য নৃপতি ছিলেন তৃতীয় হামীর। তিনি ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজত্ব করতেন। দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে ছাতনা এবং মল্ল রাজ্যের মধ্যে সীমানা সংক্রান্ত যুদ্ধ চলতেই থাকতো। রাজা হামীর তৃতীয় ও মল্লভূমের রাজা বীরমল্ল এর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শেষে তাঁরা একত্রিত হন এবং সন্ধি করেন। এই একতার প্রমাণ স্বরূপ ই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রখ্যাত একতেশ্বর মহাদেব এর মন্দির এবং ছাতনা রাজবাড়িতে মা মৃন্ময়ী দেবী(মল্লভূমের কুলদেবী) র পূজা অনুকরণে দুর্গাপূজা শুরু হয়।
(ছাতনা রাজবাড়ির মা দুর্গা)
চিত্র ঋণ:- গণ্ডবেরুণ্ড অ্যানিমেশন, শ্রী অরিজিৎ ঘোষ, শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার এবং ইন্টারনেট
তথ্যসূত্র:-
১) ‘পঞ্চকোটের ইতিহাস’ – শ্রী রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী
২) ‘অহল্যাভূমি পুরুলিয়া’ – শ্রী দেবীপ্রসাদ জানা
৩) ‘পুরুলিয়া’ – শ্রী তরুণদেব ভট্টাচার্য
৪) ‘পঞ্চকোট ও মানভূমের সভ্যতা’ – শ্রী দিলীপকুমার গোস্বামী
৫) ‘গোপভূমের স্বরূপ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ – শ্রী শিবশঙ্কর ঘোষ
৬) ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ -শ্রী বিনয় ঘোষ
৭) ‘সদগোপ কুলীন সংহিতা’ – শ্রী মোক্ষদাপ্রসাদ রায়চৌধুরী
৮) ‘সদগোপ তত্ত্ব’ – শ্রী শরৎচন্দ্র ঘোষ
৯) ‘আঠারো শতকের বাংলা ও বাঙ্গালী’ – শ্রী অতুল সুর
১০) ‘বর্ধমান ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ – শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
১১) ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ – শ্রী কবি গঙ্গারাম
১২) ‘পশ্চিমবঙ্গের মন্দির’ – শ্রী শম্ভু ভট্টাচার্য
১৩) ‘বাঁকুড়া’ – শ্রী তরুণদেব ভট্টাচার্য
১৪) ‘মল্লভূম বিষ্ণুপুর’ – শ্রী মনোরঞ্জন চন্দ্র
i )West Bengal District Gazetteers, Bardhaman District
ii)Bengal District Gazetteers, Bankura, LSS O’Malley ICS
iii) District census handbook Series 20:- Places of Historical Importance. Directorate of Census Operations, West Bengal
iv) Proceedings of Indian History Congress, 2001
v) Journal of Historical Research, Department of History, Ranchi University, 1979
vi)Broken Palace: The Lost Majesty of Bengal, Bikram Mondal
vii) Archaeological Survey of India: REPORT OF A TOUR THROUGH THE BENGAL PROVINCES, JD Beglar
Comment here