ব্লগবকানি
দেবায়ন চৌধুরী
যদি আরেকবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার সুযোগ থাকত, কঠিন কঠিন উপপাদ্য করতাম মন দিয়ে। টেস্ট পেপারের সব এক্সট্রা… আরেকটু নম্বর উঠত ফাইনালে। কিন্তু, অঙ্কে চৌষট্টি গোত্তা খেয়ে সুপুরিগাছে আটকে রইল ঘুড়ি… আমার সব মিথ্যে বাহাদুরি অশোকের ইতিহাস লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যা গেছে তা যাক। আমাদের স্কুলের স্যার বলতেন যারা বোর্ডে প্লেস পায়, তাদের থেকে তোদের মাথা ভালো। কিন্তু তোরা পড়িস না একদম। নাহলে মাত্র তিনমাস পড়াশুনো করে এই রেজাল্ট হল, সারাবছর সিরিয়াস হলে… নিশ্চিত পাড়ার মিষ্টু রাজি হত প্রেমে। অবশ্য মিষ্টুরা কিসে রাজি হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আরেকবার সুযোগ পেলে ভয় না পেয়ে বলতাম—তোকে খুব ভালোবাসি রে। শীতকালের ক্রিকেট, গরমকালের তালপাখা, শরতের মনকেমন আর বসন্তের বাতাস সবকিছুর ভেতর থেকে তোর চেয়ে থাকা ভালোবাসি। তোর বাড়ি যে এখন জনমানবহীন হয়ে পড়ে আছে, কার ভালো লাগে বল? প্রেমিকার বাড়ি যে তীর্থক্ষেত্র…
মাঝে মাঝে মনে হয় শুরু থেকে হাতের লেখাটা যদি ভালো করতে পারতাম, তাহলে দেয়ালে শ্লোগান লেখা সহজ হত। শুধু গাছ এঁকে জীবন কাটাতে পারলে আর কিছু চাওয়ার ছিল না। রং-পেন্সিল ফুরিয়ে যাবার গল্পে জন্মদিন চলে আসে। মাটি দিয়ে মূর্তি গড়া শিখতে চাই। চোখের তারার ভেতর গতজন্মের অভিমান… নিজের ডাকনাম রাখতাম ভুলোমন। যে ভুলে যেতে পারে সে সুখী। আমার অসুখ ফুরোবার নয় বলেই নোট খাতার পেছনের পৃষ্ঠায় কাটাকুটি খেলা মনে পড়ে। যে সব প্রশ্ন পরীক্ষায় আসেনি কখনো, তাদের জন্য এখনো আমার কষ্ট হয়। আমার বাতিল জীবন নিজেকেই খুঁজে পায় যেন…
শুরু বললেই স্পোর্টস মনে পড়ে। চুন দিয়ে সাজানো মাঠ। ধুলো উড়ছে, পতাকাও। শীতের নিভে আসা আলোর ভেতর কমলালেবুর খোসা। মাইক টেস্টিং, হ্যালো হ্যালো… সেদ্ধ ডিমে আঙুলের ছাপ… মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ব্যস্ততায় অন্ধকার নেমে আসে। জ্বলে ওঠে আলো। প্লাস্টিকের নতুন বালতি নিয়ে খুশিয়াল দৌড়বীর। কুয়াশার ভেতর মাইক খুলে নেয় যারা, আমি তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে শুরু করি। আকাশের গায়ে ঠেকিয়ে রাখা মইয়ের খবর সবাই পায় না। স্টার্টিং পয়েন্টে কারা এসে দাঁড়ায় যেন, মৃতদের শহরে আজ ম্যারাথন রেস!
এই জীবন নিয়ে কী করব, বুঝতে পারি না মাঝেমধ্যে। শুরু থেকে শুরু করলেই মিটে যাবে সব ঝামেলা? নাকি জীবন আদতে সহজ পথ চলা, যেখানে পথের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া বেশি কিছু করার থাকে না। জীবনের হারিয়ে যাওয়া গল্পদের ডেকে এনে ছাদে গোলবৈঠক করতে ইচ্ছে করে। চলে যাওয়া মানুষদের জিজ্ঞেস করব ভাবি– স্বর্গে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যায়? অলস রোদ্দুরে উল বোনে মেয়েরা? সন্ধ্যে হলে শাঁখ বাজে? বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রোজ নিয়ম করে পড়তে বসে? ধুর্, নিয়ম কেন থাকবে? বারে, স্বর্গে কোনো শৃঙ্খলা থাকবে না? সংলাপ চলে। চলতেই থাকে… দলবদল করতে করতে ক্লান্ত নেতা যখন ভুলে যান, কোন দলে তিনি আছেন আপাতত; ঘুমের ভেতর এক বাঁশি শুনতে পান হঠাৎ। কে বাজাচ্ছে যতক্ষণ না জানা যায় ততক্ষণ শুধু খুঁজে চলা। অস্বস্তি। ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন সব মনে পড়ে যাক শুরু থেকে। এই তো চাই। স্মৃতিকে নির্ভর করলে প্রিয় মানুষদের কথা মনে পড়ে। যারা দুঃখ দেয়, তারা কেন ভালো থাকে? যারা দুঃখ দেয়, তারা যেন ভালো থাকে।
এক নদীতে এক বারও স্নান না করা আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি শীতের সকালে। দেখি উড়ো খইয়ের ভেতর পয়সা খুঁজে খুঁজে জমিয়ে রাখছে কেউ। ভবঘুরে, পাগল যাই মনে হোক না কেন, তার চোখের নিরুদ্দিষ্ট ভাষা খুব সংক্রামক বুঝতে পারি। আকাশকে কত শাপ-শাপান্ত করে সে, বাতাসকে বকে দেয়। ঠিক সময়ে কেন খাচ্ছে না জিজ্ঞেস করে পথের কুকুরকে। এদিকে ডাস্টবিনের সংসার। বেড়ালের জমায়েত। রোদের সুড়সুড়ি। পাশের চা-দোকান থেকে পুরোনো ক্যালেন্ডার দলা পাকিয়ে ফেলে দেয়। এইসময় কাউকে জড়িয়ে ধরতেই হয়। নিজেকেই হয়তো। মরে যাওয়ার মতো ভালো লাগা বলে দেয়—এই তো শুরু হল সবে। ভ্যাকসিন এসে গেছে… আনন্দ সংবাদ আনন্দ সংবাদ… পাগলের চিৎকারের ভেতর ঢুকে পড়ে আস্ত একটা নতুন বছর…শুরু থেকে যে ভুলে যেতে ভালোবাসে। মুখে হাসি, হাতে গোলাপ…
দেবায়ন চৌধুরীর আশৈশব বড়ো হয়ে ওঠা কোচবিহারে। বর্তমানে রাজ্য সরকারি এডুকেশন সার্ভিসে সহকারী অধ্যাপক (W.B.E.S) হিসেবে কর্মরত। কবিতার বই- ‘যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’। ‘দুর্গামঙ্গল’, ‘কোচবিহার : ইতিহাস ও সাহিত্য’, ‘সাধক কবি রামপ্রসাদ’ ইত্যাদি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন।
ভালো লাগলো, দেবায়ন দা।