হাঁটুর ওপর লেপ দিলে পাহাড়, আর লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিলে গুহা। পুরোনো লেপের কিছু কিছু জায়গায় হঠাৎ ফাঁকা। তার মধ্য দিয়ে আলো আসে। দ হয়ে ঘুমোতাম। প্রতিদিন সকালে মা চিৎকার করত— গায়ের লেপ ঠিকমতো রাখিস না। মাঝরাত্তিরে উঠে দেখতে হয় আমায়…। মাঠে চেয়ারের ওপর লেপ শুকোতে দেওয়া হয়। তার ওপর বসে থাকতে বেশ লাগে। আর আমি বসে না থাকলেও বেড়াল ঠিক চলে যাবে সেখানে। একটা কুকুর এর মধ্যে তোষকের গা ঘেঁষে মুতে দিয়েছে। আমি সামনে ছিলাম না। কুল খেতে গিয়েছিলাম। তদন্ত করে দেখলাম দাগ পড়েনি। জাস্ট হালকা ছিটে। ও কিছু না। একসময় খুব বলতাম এই কথাটি। এখন আর বলিনা। নিজের কথার বদল নিয়ে ভেবে দেখিনি তো কখনও।
মুঠি পাকিয়ে পিঠে ঘুষি মারার বিশেষ টেকনিকের নাম ছিল ডলার। হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে হাত রগড়ে দিত বন্ধুরা। কিংবা হাত বাড়িয়েও বোকা বানানো—‘সময় নেই’ বলে। চুলোচুলি সমাস নির্ণয়ে ভুল হয়নি কোনোবার। পাড়ার সেলুনে মাধুরীর ছবি। পেন দিয়ে টিপ পরিয়ে দিয়েছে কেউ। দিব্যা ভারতী চলে যাওয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিল বিপুলদা। মাঝেমাঝেই বলত– মেয়েটা খুব দুঃখ নিয়ে মরল রে… কিসের দুঃখ কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি আমরা।
শীতকাল উৎসবের মেজাজ নিয়ে হাজির হলেও কোথাও কি মনখারাপেরা প্রেজেন্ট প্লিজ বলত না? আলবাত বলত। প্রতি বছর আমি লম্বা হতাম। সোয়েটার একই থাকত। ভাঙা মেলায় গরম জামাকাপড় কেনা হত। কিন্তু… দুটো শার্ট একসঙ্গে পরলে ঠাণ্ডা কম লাগে। পিসতুতো দাদার থেকে সোয়েটার চেয়ে এনেছি। গায়েও সেট হয়েছে। অল্প লজ্জা করে অবশ্য। যদি কেউ চিনে ফেলে? বাবু বলেছে— ধুর শালা। দাদারটা কি ভাই পরতে পারে না? এই কথায় বেশ জোর পেয়েছিলাম। আমার তাও আছে। বন্ধুদের অনেকেরই যে…
পাঁচ টাকার পিকনিক। ডিম দু-টাকা পিস। বাড়ি থেকে চাল-ডাল-তেল-আলু। সন্ধ্যের টিফিন মুড়ি-চানাচুর। গদাই প্রতিবার রান্নার দায়িত্ব সামলাত। বর্ষাকালে যেখানে মাছ থাকত, মাঠের পাশে সেই নিচু জমিতে আমরা পোয়াল বিছিয়ে দি। আহা কী আনন্দ! সন্ধ্যে জমাট হতেই প্রতিবেশীদের বাঁশের বেড়া ভেঙে আনা হয় সন্তর্পণে। উত্তেজনা যত, সে তুলনায় রান্না এগোয় না। ফলে অভিভাবকদের হাত লাগাতেই হয়। গলি রাস্তার আলো খিচুড়িতে মিশে যেত। পাপড় ভাজা টেস্ট করতে করতেই ফুরুৎ। খাওয়াদাওয়ার পর রাস্তা ধুয়ে দিতে কষ্ট খুব। কুকুরগুলো এসে কিচ্ছু পায় না। পিন্টুদের গ্যারাজে বেড়ালের বাচ্চা হয়েছে। ছানাগুলোর চোখ যে কবে ফুটবে কে জানে! গরুর গায়ে চটের বস্তা বেঁধে দিয়েছে ভোম্বল। মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে, আর এ যে গোবেচারা।
প্রতি বছর শীতে একঝাঁক বয়স্ক মানুষেরা চলে যেতেন। পাড়াটা কেমন ফাঁকা হয়ে যেত। হরিধ্বনি শুনলেই মনে হত—বাড়ির লোকের কী কষ্ট! দিন পনেরো সূর্য উঠছে না, বৃষ্টির মতো কুয়াশা… এমন মরসুমে রাতে শ্মশানযাত্রা মানে বেশ চ্যালেঞ্জিং। পুকুরে গিয়ে ডুব দেওয়া তো হলো, কিন্তু বাড়ি এসে আরেক সিলেবাস বাকি। আগুনের তাপ নেওয়া, তেতো খাওয়া আর লোহা ছোঁয়ার মধ্যেই আত্মরাম খাঁচাছাড়া। তবু শ্মশানযাত্রী ঠিক জুটে যেত। কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যাওয়ার গল্পে আগুনের কত রূপ… কেউ পুড়ে যায়, কেউ সেঁকে নেয় জীবন…
শীতের স্মৃতি থেকে ধুলো ওড়ে। চোখ খচখচ করে, আবার ঠিক হয়ে যায়। গলি ক্রিকেটের গল্পে নায়িকা সংবাদ। স্কার্ফের গায়ে হাসির কুচি। আঙুল ছুঁলে কমলালেবুর গন্ধ। পিকনিকে যারা ইচ্ছে করে হারিয়ে গিয়েছিল, তারা এখন কেমন আছে? যে মেয়েটি তার প্রেমিককে বলেছিল— ইস্ ঠোঁটটা ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে গেছে— সে? কোচিং ক্লাসের ছেলেটির ইচ্ছে ছিল কপালে চুমু খাবে বান্ধবীর। হয়নি। হয়ে ওঠেনি। হবেও না আর কোনোদিন। শীত এলে অগাধ সুখের মধ্যেও অন্যমনস্ক হয় ওরা। গত জন্মের কাউকে খোঁজে হয়ত। কিংবা খোঁজে না। গলিরাস্তায় কুয়াশা নামে। রিক্সারা রূপকথা হয়ে যায়…
দেবায়ন চৌধুরীর আশৈশব বড়ো হয়ে ওঠা কোচবিহারে। বর্তমানে রাজ্য সরকারি এডুকেশন সার্ভিসে সহকারী অধ্যাপক (W.B.E.S) হিসেবে কর্মরত। কবিতার বই- ‘যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’। ‘দুর্গামঙ্গল’, ‘কোচবিহার : ইতিহাস ও সাহিত্য’, ‘সাধক কবি রামপ্রসাদ’ ইত্যাদি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন।
Comment here