” প্লেগটাকে কোনমতে ঘরে ঢুকতে দিয়ো না- তোমার সভায় বেগার কাজের উমেদার আনাগোনা করে – সেই সঙ্গে ইনিও যেন গিয়ে উপস্হিত না হন । যোড়াসাঁকোর মত সুরক্ষিত জায়গায় যদি এর গতিবিধি ঘটে তাহলে তোমার বাড়ির জন্যে বিশেষরূপ আশঙ্কার কারণ মনে উদয় হয়।” পত্রাবলীর ১৪১ সংখ্যক পত্রের অংশ।
“আজ শৈলেশ আসবার কথা আছে- তাকে সবিনয়ে বঙ্গদর্শন থেকে বিরত করবার [ ‘জন্যে’] ডেকে পাঠিয়েছি- হতভাগ্য দেশে প্লেগ বাড়চে এর উপর কাগজ বাড়তে দেওয়া গন্ডস্যোপরি বিস্ফোটকং। এখন দুর্ভিক্ষ এবং মারীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাবার কাল- এখন কে বসে বসে মাথামুন্ডু রচনা করবে- আর কেই বা বসে বসে মাথামুন্ড পড়বে?” পত্রাবলীর ১৪৯ সংখ্যক পত্রের অংশ।
এখনকার এই অতিমারীর আবহে ১৯০১ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপরোক্ত চিঠি দুটির অংশ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। না , এ লেখার বিষয় অতিমারী নয় আসলে পত্রলেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটু ফিরে দেখা, চিঠির ওপারে যখন তাঁর প্রিয় বন্ধু প্রিয়নাথ সেন। রবীন্দ্রনাথ বন্ধু হিসেবে কেমন, কতটা আন্তরিক কতটা অকপট সেটাই একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা।
এই প্রিয়নাথ সেন ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি রবীন্দ্রনাথকে উৎসাহিত করেছেন সাহিত্যসৃষ্টিতে , পাঠকের কাছে রবীন্দ্রকাব্যের পরিচয় করিয়েছেন, নানা কঠিন কঠোর অভিঘাত থেকে রবীন্দ্ররচনাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বন্ধুত্বের শুরু সাহিত্যের আঙিনা থেকেই কিন্তু আস্তে আস্তে সেটার ব্যাপ্তি ঘটেছিল তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনেও। কবির জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহ স্হির করাই হোক বা ঋণমুক্তির ব্যবস্হা করে দেওয়া, লেখার কাগজের বন্দোবস্ত করে দেওয়াই হোক বা লেখার ‘কাপিরাইট বিক্রি’ র চেষ্টা করা কবি ভীষণভাবে ভরসা করতেন প্রিয়বাবুর ওপর।
সম্ভবত ১৮৮০ সালে প্রথমবার বিলেত থেকে ফেরার পর দুজনের ঘনিষ্ঠতার শুরু আর ১৮৮২ সাল থেকে দুজনের পত্রালাপের শুরু যার সাক্ষ্য বহন করছে বেশ কিছু অমূল্য চিঠি ।
কবি কখনও লিখছেন তিনি সারস্বত সমাজের হাঙ্গামা নিয়ে ব্যস্ত , কখনও লিখছেন ১১ই মাঘের গান নিয়ে বেশ ব্যস্ত, কখনও বা অপেরার রিহর্সলে ব্যস্ত তবু তার মধ্যেই সময় করে বন্ধুকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলছেন না। ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা নিজের বিবাহের সেই যে বহু চর্চিত মজার আমন্ত্রণপত্রটি, সেটি প্রিয়বাবুও পেয়েছিলেন যেখানে কবিই লিখছেন ‘ আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক ‘ । এমনকি ঐ বছরেই নতুন গৃহপ্রতিষ্ঠাতেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেননি।
মাঝে মাঝেই চিঠিতে দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বই ( বিশেষত বিদেশী ) এর আদানপ্রদানের কথা থাকত। কি কি বই রবীন্দ্রনাথ পড়তেন এই যে আমাদের একটা অপার কৌতূহল , তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় চিঠিগুলো থেকে। সেরকম কিছু বই হল Scripta Urbana, German Popular Stories , Maupassant এর Pierre & Jean, History of the Ottoman Poetry, Tolstoy এর What is Art, অক্ষয় কুমার দত্তের উপাসক সম্প্রদায় ইত্যাদি। কবি তাঁর বন্ধুকে বিখ্যাত Thacker এর দোকান থেকে কেনা বই পাঠিয়ে দিতে লিখেছেন আবার কখনও কখনও মজা করে লিখেছেন,
” দোকানে গময়িষ্যামি থ্যাকারস্য স্পিঙ্কস্য চ।
কখনং যাইতে হৈবে টাইমমবধারয়।। “
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখালিখির খবরও পাওয়া যাচ্ছে এইসব চিঠি থেকে। তিনি কখনও লিখছেন ” বিনোদিনীর খবর ভালো ” তো কখনও লিখছেন ” আমার স্কন্ধে কবিতার পুরাতন জ্বর হঠাৎ চাপিয়াছে তাই বিনোদিনী উপেক্ষিতা ” ।
১৯০০ সালে কবি লিখছেন ” আমাদের পরিবারে আজকাল এমনি দুর্ভিক্ষ বিরাজ করচে যে সে দূর থেকে তোমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না। আমি নিজের জন্যে কাল দুপুর বেলা কিঞ্চিৎ টাকা সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিলুম কিছু সুবিধা করতে পারলুম না। দেনা যে ক্রমে কত বেড়ে যাচ্চে সে বলতে পারি নে। এ দিকে আমাদের মাসহারা বহুকাল থেকে আর্দ্ধেক বন্ধ হয়ে আছে, কি করে যে শুধব ভেবে পাই নে। আমার বয়সে আমি কখনো এমন ঋণগ্রস্ত এবং বিপদগ্রস্ত হই নি।” এমন কত কথা বা টাকার ভীষণ প্রয়োজনে বই বিক্রি করার কথা কত অকপটে যে কবি লিখছেন বন্ধুকে ! কবি একবার অসুস্হ ‘বাবামশায়’কে নিয়ে বান্দোরায় সমুদ্রতীরে রয়েছেন অর্থাভাবে পড়েছেন, ওখানে তাঁকে পঞ্চাশ টাকা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করে নির্দ্বিধায় চিঠি লিখেছিলেন এই পরম বন্ধুকেই।
আবার রিক্তহস্ত অথচ ভ্রমণোন্মুখ কবি একটা চিঠিতে লিখলেন,
” ইচ্ছা সম্যক্ উপবনভ্রমণে কিন্তু পাথেয় নাস্তি !
পায়ে শিক্লী , মন উড়ু উড়ু , এ কি দৈবের শাস্তি ! “
দেখা যায় বিভিন্ন স্হানে কবি তাঁর এই প্রিয় বন্ধুর সঙ্গলাভের জন্য ব্যাকুল, কখনও বই, বন্ধু আর বিজনতার লোভ দেখিয়ে তাঁকে গাজীপুরে ডাকছেন তো কখনও ডাকছেন শিলাইদহে। বন্ধুকে স্বগৃহে আকুল আহ্বান করে লেখা চিঠিগুলো ভীষণভাবেই মন ছুঁয়ে যায়, একবার স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় চিঠি শুরুই করলেন এভাবে, ” আমি এই পুণ্যতোয়া পদ্মার দিকে মুখ করে ডাকযোগে তোমার গা ছুঁয়ে শপথ করে বলতে পারি যে তুমি যদি এস তাহলে আমি খুলনায় যাই নে- কিন্তু এই হপ্তার মধ্যে তুমি যদি না এস তা হলে যদি আমি না যাই ত আমার নাম নেই -“
অনেকদিন চিঠি না পেলেই কবির শিশুসুলভ অভিমান কী অবলীলায় যে ব্যক্ত হয়েছে চিঠিতে ! যদিও উভয় উভয়কে ‘ ভাই ‘ বলে সম্বোধন করেই চিঠি লিখতেন, কিন্তু একবার দেখা গেল অনেকদিন খবর না পেয়ে কবি প্রিয় বন্ধুকে চিঠিতে সম্বোধন করে বসেছেন ‘ অচলাটলনির্ব্বাগ্বরেষু ‘ ।
বেশ কয়েকবার বই ছাপার জন্য প্রেসে Chunder Brothers দের ইংরাজি কত পাউন্ড ডিমাই সাইজ কাগজ কত রীম পাঠিয়ে দিতে হবে তার ব্যবস্হা করে দেওয়ারও দাবি আছে বন্ধুর কাছে।
কবির যে কতরকম ভাবনা মাথায় ঘুরতো , কখনও কবি কুষ্টিয়ায় তৈরি কাপড় কলকাতায় এনে বিক্রি করে মস্ত কারবারের কথা ভাবছেন তো আবার কখনও বন্ধুকে নগেন্দ্রের সঙ্গে কুষ্ঠিয়ায় নদীর ধারে গোলাপের ক্ষেত করে কলকাতার মার্কেটে ফুল supply এর পরামর্শ দিচ্ছেন।
আরো জানা যায় শিলাইদহে পরিজনবর্গকে সন্ধেতে বই পড়ে শোনান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ , শ্রোতাদের মধ্যে যেমন কন্যা বেলা আছেন , তেমন বেলার মাও আছেন । তাই প্রিয়বাবুকে Mark Twain এর selection, ছেলেদের পড়ে শোনানোর যোগ্য ছোট ছোট হাস্যকর বা সকরুণ গল্পের বই পাঠাতে বলেছেন। এমন কত সুন্দর ঘরোয়া ছবি যে উঠে এসেছে চিঠিতে !
ছিন্নপত্রের মতোই শিলাইদহের অপরূপ প্রকৃতি বর্ণনা এখানেও বেশ কয়েকটি চিঠির সিংহভাগ দখল করে চিঠিগুলোকে এক বিশেষ উৎকৃষ্টতা প্রদান করেছে। কবি লিখছেন, ” সম্প্রতি মেঘ এবং রৌদ্র উভয়ে মিলে যেন কৃষ্ণ রাধার অফুরান্ লুকাচুরি খেলা চলচে। কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারচেন না। শেষকালে একপক্ষে কৌতুকহাস্য এবং অপর পক্ষে অশ্রুবিসর্জন পর্য্যন্ত গড়াচ্চে। “
এইসব চিঠিপত্র থেকে গুরুদেব , কবিগুরু ইত্যাদি পরিচয়ের বাইরেও এক আত্মজন রবীন্দ্রনাথের সন্ধান পাওয়া যায় যিনি তন্নিষ্ঠ পাঠক, দায়িত্ববান পিতা, আন্তরিক, বন্ধুবৎসল এবং সর্বোপরি জীবনরসিক ।
শ্রীমতী শ্রীময়ী সিনহা পেশাগতভাবে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। এছাড়াও তিনি একজন ডায়েটিশিয়ান এবং গান শোনা, বই পড়া ও অন্দরসজ্জা তাঁর বিশেষ পছন্দ।
অসাধারণ! ভাল লাগল।