অতীত যা লেখেনিরাজনীতি

বাঙ্গালীর পুনরুত্থানের হোমাগ্নি –

“এখন আমাদের মধুর রস ছাড়িয়া তিক্ত রসস্বাদ গ্রহণ করার প্রয়োজন হইয়াছে। আমরা যখন দেখিব হিন্দু মেলার সুবিস্তীর্ণ রঙ্গভূমি মল্ল বেশধারী হিন্দু সন্তানগণে পরিপূর্ণ হইয়াছে, বাঙ্গালীরা তেজস্বী অশ্বগণকে অবলীলাক্রমে ও অশেষ কৌশলে সঞ্চালন করিয়া দর্শকগণকে বিমোহিত করিতেছেন, যখন দেখিব হিন্দু সন্তানগণ বন্দুক তলোয়ার প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া উদ্যমের সহিত উৎসাহ পূর্ব্বক দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরস্পর প্রবৃত্ত হইতেছে এবং পরস্পর পরস্পরের আঘাতে আঘাতিত হইয়া রক্তাক্ত কলেবরে কেহ আহত পদে, কেহবা আহত হস্তে, কেহবা আহত মস্তকে রঙ্গস্থান পরিত্যাগ করিতেছেন, ও তদুপলক্ষে পুলিশ আসিয়া নবগোপাল বাবুর হস্ত ধরিয়া টানাটানি করিতেছে, সেইবার জানিব হিন্দু মেলার মহৎ উদ্দেশ্য অনেকাংশে সুসিদ্ধ ও সফল হইয়াছে।” (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৯শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৭৪)

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রকাশিত এই বিশিষ্ট চিন্তাধারা যা কালক্রমে Bengal School of Thought র Masculine Hinduism এ পরিণত হবে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য আমাদের কাছে। আরও বিকশিত হয়ে এই পল্লবিত ধারাটিই বঙ্গভূমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বৈপ্লবিক সংগ্রামের উৎস স্থল হবে, ১৯০২ তে শুভারম্ভ যার। বাঙ্গালী গড়েছে, লড়েছে, মেরেছে, মরেছে – এই পর্বটিতে কিন্তু পিছিয়ে আসেনি ক্ষণিকের জন্যেও; যুদ্ধে চাপ্যপলায়নমের মর্মার্থ অনুসরণ করে শুধু এগোতে হয়েছিল রক্তাক্ত কিন্তু পরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়ের মতো। সাফল্য হস্তগত হয়েছিল, অস্তমিতও হয়েছিল – দুইই সত্য যা বিশ্বাস হতে চায় না আজ।

১৯৪৭ – ২০২১ – এই দীর্ঘ ৭৫ বছরে একটি দিনাতিপাত/দিনযাপনও হয়নি যবে দেশভাগ-জনিত অসহনীয় পরিস্থিতির প্রভাব (যে কোন প্রকারেই হোক) বাঙ্গালী হিন্দু গৃহে অনুভূত হয়নি, কি এপারে কি ওপারে। দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের এক বিশাল অংশের প্রত্যক্ষ বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতিদিনই বিদীর্ণ হয়েছে বাঙ্গালী এবং হয়েই চলেছে। এখনও পর্যন্ত তাতে কোন পূর্ণচ্ছেদ দেখা যায়নি, আদৌ কোনদিন তা দেখা যে যাবেনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এবং ফল এই, যে জাতি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সমাজের প্রায় প্রত্যেক স্তরেই আপন উৎকর্ষ হেতু নেতৃত্বদান করেছে, প্রায় এক শতবর্ষের মধ্যে তা রাজপথ থেকে গলিপথের নিঃসম্বল ভিখারীতে পরিণত হয়েছে। এই চক্রান্ত যে এক অতীব উর্বর মস্তিষ্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই: এর বিরুদ্ধে সমুচিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে বাঙ্গালী ব্যর্থ হয়েছে শোচনীয়ভাবে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা ও পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ – প্রত্যেক স্থানেই বাঙ্গালী হিন্দু পদানত আজ ধর্ম বা ভাষা-জনিত বা দুইয়ের জন্যই। Our modesty is being outraged on a daily basis altogether….

কিন্তু এর বিরুদ্ধে বা এই অমানিশাকে পরাস্ত করতে আমি বা বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ সামগ্রিক ভাবে কি কাজ করেছে?
নির্দ্বিধায়, উত্তর – না। কিছুই করা হয়নি বা যা প্রয়োজন বাঙ্গালীর পুনর্ভ্যুদয়ের জন্য তার কণামাত্রও দেখা যায়নি। তার কারণ – বাঙ্গালী নেতৃত্বের ক্রমশ নিম্নগামী পথে অগ্রসর হওয়া, চরিত্রহীনতা, ধর্মহীনতা, ধ্বংসাত্মক আপোষকামী মনোবৃত্তি ও মানবিক গুণাবলীর মারাত্মক অভাব। যে গুণ কোন জাতিকে নিজস্ব উন্নতির পথে চালিত করে তা আজ সুদূর পরাহত। গত ৭৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশে কটি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে? এই অমোঘ প্রশ্নের উত্তর নেই প্রায় কোন বাঙ্গালীর কাছেই – তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, সংখ্যাটি প্রায় ২০০ কিন্তু post-World War II global scenario তে মানবতার এই প্রকার ভয়ঙ্করতম লাঞ্ছনা (এক্ষেত্রে শালীনতা – অশালীনতার যাবতীয় বিতর্ককে সন্তর্পণে একপাশে রেখে যদি ‘বলাৎকার’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় ‘লাঞ্ছনা’ র পরিবর্তে তাহলে কি তা অসমীচীন/অপ্রাসঙ্গিক রূপে গণ্য হবে?) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কারও সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়নি ক্ষণিকের তরেও। অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি প্রগতিশীল, উন্নতমনা বুদ্ধিজীবীদের (?) অবশ্য পাঠ্য ও গৃহসজ্জায় আবশ্যক হলেও, বাঙ্গালীর আসন্ন ও প্রায় অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের চিত্রাবলী নিয়ে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটে চলা অনিয়ন্ত্রিত সাম্প্রদায়িক অত্যাচার সংক্রান্ত সংবাদেও তার রুচি নেই বিশেষ: এই সুগভীর স্বার্থান্বেষী প্রচেষ্টার প্রসার ঘটছে জনজীবনে দ্রুততার সাথে, বাঙ্গালীর রসাতলে যাত্রা রয়েছে অব্যাহত।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র নীরব রইল কেন আমাদের এহেন বিপর্যয়ে? উত্তরটি অনেকেই খো়ঁজেন কিন্তু না পেয়ে রণে ভঙ্গ দেন। তাঁদের জন্যেও বলতে হবে – আমাদের অক্ষমতা, ঔদাসীন্য ও নিশ্চেষ্টতাই দায়ী প্রধানত। অকথ্য অত্যাচারও দায়ী একইরূপে… যদি এক দেহ মনে বিশ্ব সংসার মাঝে বাঙ্গালীর উপর গণহত্যার বলার অভিপ্রায় থাকতো তো কাঙ্খিত সাফল্য না এলেও বিশ্ব সংসারের সম্ভ্রম লাভ হতো নির্ঘাত। পশ্চিমবঙ্গ বিশেষত কলকাতায় অবস্থিত বাঙ্গালী লেবানেনর কোন অখ্যাত মুক্তিকামী একে-৪৭ এ সজ্জিত যুবকের বিচারবোধে মুগ্ধ এবং তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হলেও তার জানা নেই যে নাগাল্যান্ডেও বাঙ্গালী বসবাস করে ও অবদমিত হয় প্রতিদিন: সোমালিয়ার গণহত্যা নিয়ে চিন্তিত বাঙ্গালী জানেই না ১৯৭১এ ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত চুকনগর গণহত্যার কথা। ২০শে মে, ১৯৭১এ পাকিস্তান আর্মির জেহাদের আদর্শ অনুসারে ও তত্ত্বাবধানে মাত্র ২ ঘন্টায় নিহত হয় ২০, ০০০ মানুষ, অপরাধ হিন্দু হওয়া। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি…’ গাওয়া বাঙ্গালীর ধারণা নেই বিশেষ ১৯শে মে, ১৯৬১র শিলচরে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে: ডি ক্যাম্প ও তাতে বাঙ্গালীদের ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের সম্পর্কে তথ্য তো সুদূর পরাহত।

প্রতিবেশী বিহার ও ঝাড়খণ্ডে তথাকথিত মুক্তমনা সমাজতান্ত্রিকদের নেতৃত্বে কি প্রকারে দীর্ঘদিনের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় হিন্দী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে তা নিয়েও ধারণা নেই বিশেষ। এই অজ্ঞানতার উৎস তার নিজের তমসা: নির্যাতনের কথা বলে এই ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা লাঘব করা যায়না কোনমতেই এবং এটি যে কোন প্রান্তের বাঙ্গালী হিন্দুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: ‘৪৭র দেশভাগ-জনিত সর্বনাশের কালরাত্রি থেকে নিষ্কৃতি হয় নি তার এখনও।

ভবিষ্যৎ কি? সম্মুখে কি অবিরাম শূন্যতা না নিকষ কালো অন্ধকারই বিরাজ করবে? যা অধিকতর বিনাশকারী তাই অবশ্যম্ভাবী, ক্রমাগত রক্তক্ষরণে হিন্দু বাঙ্গালী মুমূর্ষু/মরণাপন্ন: দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করেও যখন এক বাঙ্গালী অন্য বাঙ্গালীর উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে না তখন সামগ্রিক মৃত্যু যে সমীপে/নিকটবর্তী বলা যায় অক্লেশে।

এমন হওয়ার কথা ছিল না: স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বৈপ্লবিক সংগ্রামের কাঠিন্য বাঙ্গালী হিন্দুকে করেছিল তীক্ষ্ণ, আগ্রাসী, সহিংস ও উদ্ভাবক। তাতেই ভীত হয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহ এ শক্তিকে নির্মূলীকরণের লক্ষ্যে রয়েছে অবিচল। পরিত্রাণ কি সম্ভব? যদি জাতিগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে এক গণ্য করা হয়, প্রত্যয় সহকারে অমানুষিক শ্রমের মাধ্যমে বাঙ্গালী পুনরায় ধর্ম পথে পরিচালিত হয়, আগ্রাসন হয় তার বিধাতা, সহিংসতা হয়ে ওঠে পূজার অর্ঘ্য, তীক্ষ্ণতা ও উদ্ভাবন হয় মন্ত্র তো পুনরুত্থান অবশ্যম্ভাবী। যতোধর্ম স্ততোজয়ঃ

Get back to basics….

(প্রন্ধটি ইতিমধ্যে অসম রাজ্যের প্রখ্যাত সংবাদপত্র ‘দৈনিক প্রান্তজ্যোতি’ তে প্রকাশিত হয়েছে)

Comment here