(পূর্বের সংখ্যার পর)
– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়
ধান পেকে গেলে কেটে নিয়ে এসে ঝাড়াই করে ধান গাছ থেকে ধান আলাদা করে নেওয়া হয়।
ঝাড়াই অর্থাৎ ধানগাছ গুলোকে বাঁশের ফ্রেমের ওপর আছাড় মারা হয়। ধান আলাদা হয়ে নীচে পড়ে থাকে। খড় গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খড় ছোট ছোট করে কেটে রাখা হয়। তাকে বলা হয় শাণি, গোখাদ্য। খড় বিচুলি গাদায় সুন্দর ভাবে সাজিয়ে stack করে রাখা হয়, যাতে বর্ষাকালে বৃষ্টিতে পচে না যায়। যে কোনো গ্রামে গেলে দেখা যায়। ঝাড়াইয়ের আগে ধানের শীষ থেকে পুরুষ্টু ধান বেছে নেওয়া হয়। মাটি বা অন্য কিছু বেছে ফেলে দেওয়া হয়। কয়েক বস্তা বোঝাই করা হয়। এগুলো হল বীজধান। কাজটি করা হয় স্নানকরে পরিস্কার কাপড় পরে। পরে বোশেখ মাসে রোদ খাওয়ানো হয় দু এক দিন। পরের বছর বোনা হবে।
আমাদের বাড়ীতে ধানের গোলা আছে; তাতে ধান জমানো থাকে ভবিষ্যৎ ও দুর্দিনের জন্য। গোলায় পোরার আগে ধান সেদ্ধ করে নেওয়া হয়। উদ্বৃত্ত ধান গোরুর গাড়ীতে বোঝাই করে হাটে নিয়ে যাওয়া হত, বিক্রির জন্য। সবুজ বিপ্লব ৫০-৬০ এর দশকে। নেতৃত্ব দেন বিশ্ব বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী নরমান ই বোরলাগ। উনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ভারতে সবুজ বিপ্লব আনেন ডঃ স্বামীনাথন। এশিয়া ইউরোপ আমেরিকা থেকে দুর্ভিক্ষ দূর হয়েছে।
আফ্রিকায় সবুজ বিপ্লব হয়নি। তাই ইথিওপিয়া, এ্যাঙ্গোলা মাঝে মাঝে শিরোনাম উঠে আসে দুর্ভিক্ষের কারণে। এখানে জার্মান বৈজ্ঞানিক হেবার-এর নাম করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উনি নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনকে যুক্ত করে এ্যামোনিয়া তৈরী করেন। তার থেকে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট তৈরী হয় আজ সারা বিশ্ব জুড়ে। এটা জমিতে সার হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। আজ বিশ্বে যত খাদ্যশষ্য উৎপন্ন হয়, তার অর্ধেকও উৎপাদিত হত না, ঐ সার না থাকলে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। শেষ হয় ১৯৪৪ সালে। হেবার সাহেব এ্যামোনিয়া তৈরী করেছিলেন প্রধানত নাইট্রিক এ্যাসিড বানাবার জন্য। নাইট্রিক এ্যাসিড বারুদ বা গান পাউডার বানাতে লাগে। যুদ্ধের প্রয়োজনে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় প্রচুর বৈজ্ঞানিক আবিস্কার হয়েছিল। সবচেয়ে দামী আবিস্কার এটম বম্ব। ম্যানহাটন প্রজেক্ট। শ্রী নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বইটিতে ম্যানহাটন প্রজেক্টের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আছে।
আমাকে খুব ছোটবেলায় হাঁপানি ধরে ফেলে। খুব ছোট ফ্ল্যাটে থাকতাম। অক্সিজেন কম থাকত। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হত। পড়াশুনার ক্ষতি হত। বেটনিলান নামক স্টেরয়েড রোজ খেতে হত। দেশে গিয়েও।
একদিন সকালবেলায় খুব হৈ চৈ। আমাদের নদীর চড়ার জমিতে হেলিকপ্টার নেমেছে। কাঁচা রাস্তায় গরুর গাড়ী আর সাইকেল চলতে দেখতাম। অটো, টোটো, মোটর সাইকেল কি গাড়ী চলতে দেখিনি। সেখানে একটা আস্ত পুস্পক রথ! আকাশ থেকে নেমে এল। পাইলট বিদেশী। কিছু অফিসার গোছের লোক হাতে খাতা পত্তর ও যন্ত্রপাতি নিয়ে কথাবার্তা বলছে। প্রচুর গ্রামবাসীর ভীড়। আমিও সামিল। এর ২০ বছর পর আমি ফিজিক্সে পিএইচডির করে ওএনজিসি তে ( অল ইন্ডিয়া কম্পিটিশন) ক্লাস ওয়ান পোস্টে যোগ দেই আহমেদাবাদে। আমার ডেসিগনেশন ছিল জিওফিজিসিস্ট। সেইসময় রাঙা কাকা বলেছিলেন মনে পড়ে সেই হেলিকপ্টারের কথা? ওর পরেও কয়েকবার এসেছিল। ওগুলো ONGCর , পেট্রোলিয়াম খোঁজে ওরা।
জিওফিজিক্সের দুটো ভাগ – পেট্রোফিজিসিস্ট ও সিসমিক। ওটা ছিল সিসমিক পার্টি।
সিসমিক পার্টি কোনো মাঠের ওপর বম্ব ব্লাস্ট করে। তার ফলে শব্দতরঙ্গ মাটির তলার বিভিন্ন স্তরে প্রতিফলিত হয়ে ওপরে উঠে আসে। মাটিতে অনেক রিসিভার রাখা থাকে পর পর। যত নীচের স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসে, তত বেশী সময় নেয়। কম্পুটার এসব এ্যানালিসিস করে। সেই ডেটা ইন্টারপ্রিটেশন করে ও তার সাথে স্থানীয় জিওলজিক্যাল ডেটা মিলিয়ে আন্দাজ পাওয়া হয় কোথায় একটা কূপ ড্রিল (খনন) করলে পেট্রোলিয়াম পাওয়া যেতে পারে। বনগা অঞ্চলে কূপ ড্রিল করা হয়নি। সাম্প্রতিক কালে হাবড়া অঞ্চলে ড্রিল করে তেল পাওয়া গেছে বলে শুনেছিলাম। সারা পঃবঙ্গে আর কোথাও তেল বা গ্যাস পাওয়া যায়নি।
গুজরাটে Ongcর কাজে কখনো কখনো দু রাত কনটিনিউয়াস ফিল্ডে থাকতে হয়েছে। তখন লক্ষ্য করলাম ওষুধ না খেয়েও ভাল আছি। গুজরাট ড্রাই ও গরম জায়গা। কোনো ওষুধ ছাড়া অনেক ভাল থাকি ওখানে। কলকাতা পলুউটেড ও আর্দ্র। হাঁপানির পক্ষে খুব খারাপ। ছোটবেলায় যোগ ব্যায়াম করলে এটা সেরে যায়। নিয়মিত সাঁতার কাটলেও উপকার পাওয়া যায়। খুব সাঁতার কাটতাম ছোটবেলায় ইছামতি নদীতে যখনই দেশে থাকতাম। ইছামতি নদী বাংলাদেশের ভৈরব নদীর শাখা নদী।
ভৈরবী আবার পদ্মার শাখানদী। ইছামতি দুই বাংলার আন্তঃসীমান্ত নদী। পঃবঙ্গে তিনটে টাউন এর তীরে অবস্থিত। বনগা, টাকি ও বসিরহাট। কোনো নদী অন্য নদী থেকে বেরলে সে শাখানদী। কোন নদী অন্য বড় নদীতে পড়লে সে উপনদী। যেমন যমুনা।
ইছামতি বর্তমানে পলি (সিলটেশন) জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং তারফলে শীত কালে এটি কেবল সরু খাতে বইছে এবং বর্ষায় বন্যার কবলে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতি সন্মন্ধে সচেতন এবং সঙ্কট সমাধানে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রধানত যেটা দরকার সেটা হল ড্রেজিং বা বিশেষ জাহাজে করে পলি তোলা। ড্রেজিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া এই কাজটি করে থাকে। খুবই ব্যয়সাপেক্ষ কর্মকান্ড।
আর একটি সমস্যা যেটি নিজে দেখেছিলাম বহুবছর আগে, কচুরিপানার আধিক্য।
গ্রীষ্মে বাড়ী গমগম করতো সহোদর, খুড়তুতো ভাইবোন, নানা রকম আত্মীয় স্বজনে। স্নান করতে যাওয়াটা উৎসব বিশেষ ছিল। নদীতে পড়লে আর উঠতাম না। ১ ঘন্টা বা তার বেশী সময় কোথা থেকে কেটে যেত। কতবার এপার ওপার হতাম। সবাই ভাল সাঁতার জানতাম। যতক্ষন না কোনো কাকা কঞ্চি হাতে ঘাটে উপস্থিত হতেন, ততক্ষন নদীবিলাস চলত।
নদীতে বাঁশের খুটি ধরে পা দাপাতাম, কয়েক দিন এরকম করে হাত ছেড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করতাম। আবার খুটি ধরতাম। এই ভাবে সাঁতার শিখেছিলাম সবাই। চিত্রগ্রীবের ওড়া শেখার মত।
(ক্রমশঃ)
(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)
Comment here