আঙিনা

দেশ – ৯

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

১৮৩১ সাল। একটি বাণিজ্য জাহাজ নাম বিগল (HMS Beagle) কিছু দিনের মধ্যে ইংলন্ডের প্লাইমাউথ বন্দর থেকে সমুদ্রযাত্রায় যাবে। বাণিজ্য যাত্রা। বিভিন্ন দেশের বন্দরে মাল নামাবে, আবার অন্য দেশে পৌঁছে দেবার জন্য মাল তুলবে। দুবছরের ওপর সময় লাগবে ধরা হয়েছিল এই সমুদ্র তথা বাণিজ্য যাত্রায়। প্রকৃতপক্ষে সময় লেগেছিল ৫ বছরের কাছাকাছি। 

জাতের ক্যাপ্টেন ফিটজরয়। উনি বিজ্ঞান মনস্ক ছিলেন। উনি আগেও লম্বা সমুদ্রযাত্রায় গেছেন। ওনার আবহাওয়ার লক্ষণ দেখে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট ছিল। মনে রাখতে হবে ঐ সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলে কিছু ছিল না। ফিটজরয় কে ওয়েদার ফোরকাস্টিং এর পায়োনিয়র ধরা হয়। সামনে দীর্ঘ যাত্রা দেখে উনি বিজ্ঞাপন দিলেন , কথা বলা ও সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন শিক্ষিত ব্যাক্তি কে তিনি ফ্রী তে আসন্ন যাত্রায় সঙ্গী করবেন, তবে সেই ব্যক্তির ইন্টারভিউ নেবেন। অনেক ভ্রমনেচ্ছু আবেদন করলেন।

ক্যাপ্টেন ফিটজরয় এক যুবক কে সিলেক্ট করলেন। যুবক ২২ বছরের সদ্য স্নাতক, জিওলজিস্ট। ফসিল নিয়ে ফিল্ড/ প্রাক্টিক্যাল স্টাডি করতে চান। জাহাজ প্লাইমাউথ সাউন্ড থেকে ২৭.১২.১৮৩১ তারিখে যাত্রা শুরু করে ২.১০.১৮৩৬ তারিখে ইংলন্ডে ফিরে আসে। প্রায় ৫ বছর ধরে সমুদ্রযাত্রা চলেছিল।

ক্যাপ্টেন পুরো সময় জাহাজেই ছিলেন। যুবক ৩ বছর ৩ মাস ল্যান্ডে ছিল। জাহাজ আটলান্টিক পেরিয়ে দক্ষিন আমেরিকার দুই উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে থেমেছিল। যুবক ওই সব উপকূলে ও সন্নিহিত দ্বীপপুঞ্জ গুলো থেকে অনেক ফসিল (জীবাশ্ম) সংগ্রহ করেছিল এবং সেগুলোর ওপর ডায়রি তে প্রচুর নোট লিখেছিল। সবচেয়ে বেশী ফসিল সংগ্রহ করে ছিল ইকুয়েডরের কাছে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে।

ওখানে যুবকটি লক্ষ্য ও লিপিবদ্ধ করেন যে একটি পাহাড় থেকে যখন ১ মিটার করে নামছিলাম ফসিল গুলো ১ লক্ষ বছর পিছিয়ে যাচ্ছিল। জাহজটি পৃথিবী পরিক্রমা করে তাহিতি, অস্ট্রেলিয়া হয়ে ইংলন্ডে ফিরে আসে। যুবক ফিরে এসে একটি বই লেখেন, “Voyage of Beagle”| বইটিতে প্রচুর বৈজ্ঞানিক তথ্য ছিল। ছিলেন ভূবিজ্ঞানী, হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী।
ওঁর নাম চার্লস ডারউইন।

চা্র্লস ডারউইন ১৮৩৬ এ ফিরে এসেছিলেন। প্রথমে লিখলেন “Voyage of Beagle’| মূলতঃ জিওলজির ওপর লেখা। কিন্তু ওনার মাথায় ঘুরছিল Natural Selection and Evolution. ১৮৪৩ এ লিখলেন “Zoology of the Voyage of HMS Beagle”| এই বই ডারউইনকে জীববিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিল। ওনার মাথায় ঘুরছিল Evolution through Natural Selection|

কিন্তু ভয় ছিল চার্চ মানবে না, উল্টে গ্যালিলিওর মত ওনাকেও ফাঁসি দেবে। ওনার ভাগ্য কিছুটা সহায় হল। 

১৮৩২ থেকে সমাজে খুব বিক্ষোভ চলছিল। চার্চের বিরুদ্ধমত জোরদার হচ্ছিল। সেইসময় ডারউইন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হাক্সলী ও বিখ্যাত ফিলোজফার হার্বার্ট স্পেন্সারের মত লোককে ও আরো অনেককে বন্ধু হিসেবে পেলেন। ডারউইন উৎসাহিত হয়ে তিন ভলুমে ধীরে ধীরে “Evolution through Natural Selection” লেখা শুরু করলেন। ১৮৫৮ জুনে একটি চিঠি পেলেন জনৈক Alfred Russel Wallace , British naturalist- র কাছ থেকে। তাতে ওয়ালেস জানালেন উনি মালয় দ্বীপে অনুসন্ধান চালিয়ে ন্যাচারাল সিলেকশন টাইপের থিওরীতে উপনীত হতে চলেছেন। ডারউইন ভয় পেলেন, ওনার এত দিনের সাধনার কৃতিত্ব অন্য কেউ পেয়ে যাবে। ..ডারউইন আর দেরী না করে বাকী অংশ তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে পাবলিশ করলেন “Evolution through Natural Selection and Origin of Species” . ২২ যে নভেম্বর, ১৮৫৯। সমাজ তখন যথেস্ট সভ্য হয়েছে।

Meritocracy and Science সমাজের উচ্চস্থানে অবস্থান করছে, তাই ডারউইন কে আর ফাঁসীকাঠে চড়তে হয়নি। সারা পৃথিবী জানল মানুষের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছিল। তার সাথে আরো অনেক কিছু। Natural Selection , Adaptation etc.
Charles Darwin’s theory of evolution states that evolution happens by natural selection. Individuals in a species show variation in physical characteristics. … Individuals with characteristics best suited to their environment are more likely to survive, finding food, avoiding predators and resisting diseases…যদিও অনেক ফিলোজফার বিশ্বাস করেন মানুষ এসেছে বহির্জগত বা Outer Space থেকে।..এটা নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছে রইল।

বিনোদন – 

সেই সময় গ্রামের তথাকথিত (শহুরে) বিনোদন বলতে ছিল রেডিও। ( TV তখন কলকাতায় আসেনি)। বনগা টাউনে দুটি সিনেমা হল, বনশ্রী ও হীরামহল। বনশ্রী তে নতুন , পুরোনো বাংলা বই, হীরামহলে পুরোনো হিন্দি বই দেখাতো। বাড়ীতে যে রেডিও সেটটি ছিল , সেটি সোনা কাকার হাতে বানানো। ট্রান্সিসটর সেট। ভালই চলত। কলকাতায় বাসায় ছিল মার্ফি র ভালভ সেট। শুক্রবার রাত আটটায় নাটক, শনিবার , রবিবার দুপুরে অনুরোধের আসর। রবিবার রাতে ছায়াছবির গান। এছাড়া সারা সপ্তাহ জুড়ে নানা অনুষ্ঠান। .রবীন্দ্রসঙ্গীত, গল্প দাদুর আসর, পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীত শিক্ষার আসর , ইন্দিরা দেবীর শিশু মহল, রম্যগীতি, পল্লী কথা।

আগেই লিখেছি সেই সময় সবুজ বিপ্লব সাড়া ফেলছে। রেডিও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সেই বার্তা কৃষকদের মধ্যে পৌঁছে দিতে। তখন রেডিও সেট এর জন্য লাইসেন্স লাগত। বছরে ১০-১৫ টাকা ফীস জমা দিতে হত। ৮০র দশকে এই লাইসেন্স সিস্টেম উঠে যায়।

অনুরোধের আসরের শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই এখন নেই। বর্তমান প্রজন্ম নামই শোনেনি। মহিলা শিল্পীদের মধ্যে আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বসু, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উতপলা সেন , মাধুরি চট্টোপাধ্যায, সুমন কল্যানপুর, আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, হৈমন্তী শুক্লা, লতা আশা সন্ধ্যা তো ছিলেনই প্লাস সব নাম মনে নেই। পুরুষ শিল্পী দের মধ্যে জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল , তরুন বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তালাত মামুদ, পিন্টু ভট্টাচার্য, সুবীর সেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মুকেশ, রফি, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, হেমন্ত ও ওনার ভাই অমল মুখোপাধ্যায়। এনাদের যুগ কে বলা হয় বাংলা গানের স্বর্ণযুগ।

পুরোনো দিনের গান কেন ভাল লাগে? তখন মা বাবা ভাই বোন , কাকা বা মামা মিলে গান শুনতাম। জায়গা ছোট হলেও দিব্বি থাকতাম একসাথে। পুরোনো গানে সেই স্মৃতিগুলো বুকে ঘাই মেরে যায়, মনে ঝিলিক দিয়ে যায়। এখন অনেকের বাবা মা জীবিত নেই, ভাই বোন দূরে দূরে ( ভৌগলিক বা মনের দিক থেকে)।

পুরোনো গানে তাই প্রাণ নিভৃতে কাঁদে।

 

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here