বিসমিল্লা খানের বাড়ীটা বাঁচানো, সংরক্ষণ করা অবশ্যই উচিত ছিল – এ নিয়ে কোনো সংশয়ই নেই।
প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে এ নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায়; (কারণ বৃষ্টির দিনে, লকডাউন মৌতাতে, পকোড়া কফির সাথে এমন হাল্কা উত্তাপজনিত আলাপ আলোচনা এক্কেবারে খিচুড়িতে ইলিশভাজার মতই জমে)।
‘সরকারী উদাসীনতা’,’সংস্কৃতির প্রতি অজ্ঞানতা’, ‘দায়হীনতা’ – পরিচিত এই স্ট্রোকগুলো খেলে বলকে বাউন্ডারির দিকে ঠেলে মাঠ গরম রাখাই যায়। কিন্তু, এমন ‘চার’, ‘ছয়’ মারনেওয়ালাদের যুক্তির প্রেক্ষিতেও প্রশ্ন কিছু ওঠেই,উঠছেও।
অনেকেই বলছেন, ‘বিসমিল্লাহ জীর পরিবার যদি এই সিদ্ধান্ত নেয়,কার কি করণীয়।’ উল্টোপক্ষের যুক্তি আসছে, ‘সরকার কেন অধিগ্রহণ করল না?’ ইত্যাদি। প্রতিযুক্তিতে অতীতের বহু সংরক্ষিত না হওয়া শিল্পীর শিল্পকর্ম বা বাসস্থানের প্রসঙ্গ আসছে এবং ফলশ্রুতিতে respective সরকারকে দোষারোপে গিয়ে ম্যাচ পণ্ড হবার অবস্থা।
সরকার কি পারে,কি পারে না, কি তার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বাধা বা বাধ্যতা, তা আমার মত তুচ্ছপ্রাণের জানাত কথাও নয়।
খুব সাম্প্রতিক অতীতে ম’নে পড়ছে বম্বেতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতাঞ্জলি’ বিক্রি হয়ে যাবার কথা। তাঁর কলকাতাস্থ বাড়িও বিক্রি হয়ে গেছে আগেই।তাঁর সন্তান বা তাঁর অন্যান্য উত্তরাধিকারদের সম্মতিতেই।সরকার তখনও কিছু ব’লেছেন বা করেছেন ব’লে ম’নে পড়ল না।ফেসবুক খুললেই ‘হেমন্ত-প্রেমী’ অসংখ্য গ্রুপে অগণন হেমন্ত ভক্ত সারাক্ষণ পিলপিলিয়ে বেড়ান। এই বাড়ি বিক্রি আটকাতে তাঁরাও মিলিতভাবে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করেন নি, বা নিজেরা কোন আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন ব’লে জানা যায় নি..
এর পরেই দেখেছিলাম বিখ্যাত ‘আর কে স্টুডিও’ বিক্রি হয়ে যাবার খবর। সে খবর দেখে হাঁ হয়ে ভেবেছিলাম, বম্বে ইন্ডাস্ট্রির স্তম্ভস্বরূপ ‘কাপুর’রা তাঁদের পরিবারের এমন ঐতিহ্য যা একই সঙ্গে ভারতের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী নাম,সেই স্টুডিও রক্ষা করবেন। কিন্তু, করিনা থেকে রণবীর সব্বাই ‘ফিলিং নস্টালজিক’ স্ট্যাটাসে সেন্টুসেন্টু মার্কা কথা ‘আহা, ছোটবেলায় অমুক ছবির শ্যুটিং এ আমি বাবার কোলে চ’ড়ে দেখতে এসেছিলাম’ জাতীয় ছবি আর বাণী পোস্টানো ছাড়া আর কিছুই করতে দেখলাম না..
মহারাষ্ট্র সরকারও এ স্টুডিও অধিগ্রহণের জন্য কিছু করেছে ব’লে খবর মেলে নি।
তা এবারে হঠাৎ প্রতিবাদ,বুক চাপড়ানো,হাহাকার, পাপ স্বীকারটা বড্ড বেশী মাত্রায় হচ্ছে না কি?? এটা কি রাজ্যটা নির্দিষ্ট রাজ্য বলেই, যেখানে প্রশাসনিক কঠোরতা সাম্প্রতিককালে খবরে উঠে এসেছে বারবার??
বিসমিল্লাহ খান সাহেব আমেরিকায় settled হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘গঙ্গাটাকে যদি এখানে আনা যায়,তবে আমি আসতে পারি’। এ কথার পর সত্যিই বারাণসীর উচিত ছিল, তাঁর সুরমন্দির রক্ষায় সচেষ্ট হবার। কিন্তু, সে কাজে যোগী সরকার জোরাজোরি করলে, কে বলতে পারে,সুশীল সমাজ ‘শিল্পীর সন্তানদের অধিকার হরণ’ এর অভিযোগ আনত না সরকারের বিরুদ্ধে।
তাঁর foster daughter ডঃ সোমা ঘোষ, বহু জায়গায়,বহু আসরে ওস্তাদজীর সঙ্গে যাঁর যৌথ পরিবেশনে এবং যাঁর প্রতি ওস্তাদজীর ব্যাবহার এটাই নিশ্চিত করে যে, তিনি হচ্ছেন তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। এবং পিতাপুত্রীর এই সম্পর্ক কতখানি ,তার প্রমাণ, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ডঃ আব্দুল কালাম কর্তৃক তাঁর বাসভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা পেয়েছেন। শেষদিকে ওস্তাদজীর এমন বহু অনুষ্ঠান এবং তার বাইরেও ডঃ ঘোষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এ মেয়ের কণ্ঠস্বর ও সঙ্গীতে গর্বিত পিতা তাঁকে আদর ক’রে ডাকতেন ‘বানারস কি বুলবুল’ নামে।তাহলে, প্রশ্ন ত সহজে আসেই, এ হেন পুত্রীর কেন কোনো অধিকার রইল না বাবার সুরসাধনক্ষেত্রটি ভাঙা নিয়ে কোনো জোরালো বক্তব্যের??? বাবার রেওয়াজের ঘরটুকু অন্তত রাখতে চেয়ে কেবলমাত্র বিনীত আবেদনটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হল তাঁর ভূমিকা।
বারাণসী ছেড়ে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক এ বঙ্গের দিকে। উত্তরপ্রদেশে ত সরকার না হয় রাখতে পারে নি,আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথের নোবেলটুকু রাখতে পেরেছি ত!?? তা কি সরকারী প্রতিষ্ঠানের আওতায় ছিল না!??
আচ্ছা,শরৎ পণ্ডিত,অর্থাৎ আমাদের প্রিয় দাদাঠাকুরের সেই ‘পণ্ডিত প্রেস’ – র কি খবর বলতে পারেন?? দাদাঠাকুরের অস্থিমজ্জাস্বরূপ সেই প্রেস কবেই একটা মুদির দোকান হয়ে গেছে -আপনি খবর রাখেন?
বিসমিল্লাহর বাড়ী গেলেও,রইল তাঁর সানাই(বস্তু সানাইগুলো যদিও গলিয়ে বেচে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য নাতিরা,এবং তারপর সেই গলা রূপোই উদ্ধার করেছিল পুলিশ) তাঁর সুর। কিন্তু, এ বঙ্গের নিজস্ব লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন ‘আলকাপ’ সম্রাট ‘ঝঁকসু’র ভাগীরথী তীরের ধনপতনগরের ভগ্নপ্রায় বাড়ীটা,যেখানে নিয়মিত আসরে রোজ জন্ম নিত নতুন গান, আগাছা জমতে জমতে জমতে এতদিনে আর অবশিষ্ট আছে কিনা, খোঁজ নিয়েছেন কখনও??..
কৃষ্ণনগরের প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি ‘রাণীকুঠি’,যে বাড়িতে এসে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ, প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত সে বাড়িকে heritage ঘোষণা করানোর জন্য কটা চিঠি লিখেছেন সরকারকে??
সেদিন যেতে যেতে কাঁকুলিয়া রোডে হঠাৎই চোখে পড়ল ফলক, ‘এই বাড়ীতে সুরসাধক অনুপম ঘটক আমৃত্যু বসবাস করেছেন’- তাকিয়ে দেখি খুব বেশি হলে বছর আটের এক ঝাঁ চকচকে বহুতল। নিশ্চয় পঞ্চাশের দশকে গত হওয়া সুরকার এই ঝাঁ চকচকে হাল আমলের বহুতলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নি। তাহলে, সেই বাড়ি যখন ভাঙা পড়ল, আজকের ফেসবুকে ব্যাট চালানো ক’জন সুশীল কলম ধরেছিলেন???
আসলে কি জানেন সকাল বিকেল রান্নার ছবি দিয়ে, বিলাসী বৈঠকখানায় কুকুর আহ্লাদের ভিডিও ক’রে, কিম্বা জিলিপি সাইজের আংটি প’রে ফেসবুকে রিলিফ দান অথবা রবীন্দ্রপালনের লাইভজনিত আরামপ্রিয়তায় মাঝে মাঝে মুখ ম’রে যায়।তখন স্বাদ পাল্টাতে এ হেন প্রতিবাদী ঝালটাকনা।
নিজের কাছে অন্তত স্বীকার করুন।
আজ যে ইউটিউব খুললেই পুরোনো বাংলা ছবির নস্টালজিয়ায় মেতে আপনি ‘feeling ‘মেদুর’ জানান দেন, সেগুলো থাকত না যদি না দুই অবাঙালী ভাই নিয়মিত হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন কালোয়ারদের কাছে,যেখানে নিয়মিত ফিল্ম ক্যান বেচতে যেতেন ছবির পরিচালক,প্রযোজক থেকে শুরু করে চিত্রনাট্যকার অব্দি সবাই।কারণ ঐ সেলুলয়েড গলালে অনেক অনেক রূপো বেরোতো।
এই দুই অবাঙালী ভদ্রলোক, শ্রী অভয় তাঁতিয়া ও তাঁর ভাই, তাদের হাতে পায়ে ধরে ওই রূপোর দামের কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাঁচাতেন সেই ক্যানগুলো।পরে তাঁরাই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘অ্যাঞ্জেল ভিডিও’ -আজ ইউটিউব ভিউয়িং থেকেই যাঁদের আয় মাসে প্রায় কোটি টাকা।
এই তো আপনার আমার ‘সংরক্ষণ’ প্রবণতার ইতিহাস মশাই..
বাংলাদেশে মাচা করতে যান যখন,আপনার বাপ পিতেমোর genocide এ অংশ নেওয়া চাচাজান ভাইজানের গলা জড়িয়ে শাড়ী বা ইলিশ ভিক্ষে নেন যখন – একবারও জিজ্ঞেস করেন, ‘এখানে সূর্য সেন,যতীন মুখুজ্যের ভিটেটা নিশ্চিহ্ন হল কেন?’ বা ‘শ্রীপুরের অতূলপ্রসাদের স্মৃতিমাখা কাছারিবাড়ী এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ব্রাহ্ম মন্দিরের এ হাল কেন?’…বলতে বসলে সংখ্যায় কুলোবে না।
সবশেষে একটা প্রশ্ন রাখি?
জীবনের মোক্ষ, ধ্যান,জ্ঞান চরিতার্থ করতে, সেই যে রানাঘাট বা হালিশহর বা গুপ্তিপাড়া বা সুভাষগ্রাম বা লক্ষ্মীকান্তপুর বা সাহাগঞ্জে আপনার বংশের অগ্রজদের রক্ত জল ক’রে বানানো মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু(যা পরবর্তীতে বাগানে পুকুরে সাজানো হয়েছিল) বেচে আপনি এক লাফে এসে উঠলেন নয়াবাদ কি কেষ্টপুরের দেড় কামরার ঘুপচিতে, তখন ম’নে হয় নি, ‘আমার ঠাকুর্দার রক্তজল লেগে আছে অবহেলায় ফেলে আসা সেই বাড়ীর প্রতিটি ইঁটে’। চন্দননগরের দোতলা বাড়ি যা শ্যামবাজারস্থিত আপনার বর্তমান আবাস থেকে ‘গিয়ে মেনটেইন করা অসম্ভব’ হ’য়ে যায় আপনার সাপ্তাহিক স্পা বা ক্লাবের সময়ে ভাগ বসায় ব’লে, সেই আপনিই ত ওস্তাদজীর বাড়ী নিয়ে সরব হবেন – এটাই ত স্বাভাবিক। চন্দননগর কি ব্যারাকপুর কি শ্রীরামপুরের সেই ছেড়ে আসা বাড়ির চিলেকোঠায় হয়ত কত তানপুরা, তবলা তখন এগোতে থাকে তার ধুলিযাত্রার দিকে।
পরিবারের বিখ্যাত পূর্বপুরুষ নিয়ে লিখতে বললে অব্দি যাদের ধানাইপানাই কাটাতে চব্বিশটা ফোন করতে হয় এবং তারপরেও কাটে না,এলাকার ভগ্নপ্রায় নির্মাণকাজগুলোর লিস্ট করতে বললেই যারা ‘মানসিক অস্থিরতা’ নামক অসুখের ‘শিকার’ হয়ে ওঠেন, ফেসবুকে তাঁরাই আজ গলা তুলেছেন,কারণ, ন্যূনতম শারিরীক শ্রম বা মানসিক স্থৈর্যটুকুও ছাড়াই এ বিপ্লবের আগুন জ্বালানো যায়। কখনও তা সুশান্তের হত্যাকারীর শাস্তির দাবীতে, কখনো মন্দির স্থাপনার কুফল রচনায় আবার কখনো তা সুরসাধকের বাসস্থান বাঁচানোয়…
অতএব, কমরেড,অনেক হল। জানি সারাদিন ঘিলু ধার দিয়ে দিয়ে, আপনি সত্যিই বিপর্যস্ত। এবার ফ্রিজ খুলুন।গ্লাসে দুটুকরো বরফ সহযোগে, পছন্দের পাণীয় ঢেলে, নরম আলোটা জ্বালিয়ে Yanni চালিয়ে সোফায় গা এলান।
মাথার কাজ অনেকটা ক’রে দিয়েছেন..বাকিটুকু করুক সাধারণেরা..
আপনাকে ত এদের ফুড ফর থট যোগাতে হবে আবার কাল সকাল হলেই..
অতএব ঝিম ধরা সুরে,সুরায়,লাইকপ্রাপ্তিতে আর সম্মিলিত হুক্কারবের শিখরে বিরাজ করুক আপনার ফেবুবিপ্লব, আর তার থেকে ক্রমশ দূর,দূর,দূর আরও দূরের ঠিকানায় নির্দিষ্ট হতে থাক, মুখহীন মানবতার,কর্মযোগের যত রক্ত,ঘাম,শ্রমভেজা নিরুচ্চার নিখাদ প্রয়াস।
শ্রীমতী দোলন ঘোষ বিগত ১০ বছর যাবৎ আকাশবাণী এফ এম এ উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তৎসহ দীর্ঘদিন ধরে তিনি চলচ্চিত্র গবেষণায় নিবিষ্ট ও নিজস্ব স্বাধীন ব্যবসার সাথেও যুক্ত।এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here