ভাইয়ের হাত
ভাজের হাত
বোন চলেছে ভাইয়ের বাড়ি। গ্রামের আলক্ষেতের মেঠো পথ, কতদিনের চেনা, কতদিনের জানা। চেনা একসহ। চেনা মানুষ জন, চেনা নদী, . চেনা গাছগাছালি ঘাস পাতা। ধনেজমি সবই চেনা। তার কত আপন, কতদিন পরে দেখা, বোনের চোখে জল, তাদের সেই চির আপন, চিরদিনের চিরকালের ধান জমি, ধান জমি নয় ভাত জমি, জমিতে কাজ করছে তার বড় আদরের ছোট ভাই, বোনকে দেখে ভাইয়ের মুখভরা হাসি, আজ নবান্ন, অন্তরের টানে বোন আজই চলে এল। খুশিতে ডগমগ ভাই বললে, ‘কতদিন পরে এলি বোন!’ “‘চ’ বাড়িতে ‘চ’।” ‘আমিও হাতের কাজটুকু সেরে এক্ষুনি যাচ্ছি।’
ননদকে দেখে ভাজের (ভাইয়ের বৌয়ের) মুখ ভার। দু-বছরের দুষ্টু-মিষ্টি খোকা। বোন ছুটে এসে আদর করে কোলে তুলে নেয়, ভাজ ব্যাজার মুখে বাধা দেয়. ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না। খোকাকে এখন তেল মাখিয়েছি।’
বোন কাঁচুমাঁচু মুখ করে আস্তে আস্তে কল থেকে খোকাকে নামিয়ে দেয়।
সুন্দর লকলকে লাউ গাছ মাচায়; বোন বললে লাউ শাক কর না বউ।
বৌয়ের মুখে আষাঢ়ের মেঘ
ঢোলা ঢোলা লাউয়ের পাতা
তোমার ভাইয়ের সোনা গাঁথা।
কাটলে তার রক্ষে আছে!
বউ খুব চচ্চড়ি খেতে দিল। তাই খেয়ে বোন হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছে নিজের ঘরে। বাপ-মা মরা বাড়িতে আজ আর কোন কদর নেই তার। তাদের সেই ধান জমি, জমি ভর্ত্তি ধান গাছ। হাওয়ায় দুলছে। বোনকে দেখে তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না।
বোন থোড়ওলা পুষ্ট গাছগুলোকে পরম মমতায় হাত বুলোতে বুলোতে কাঁদে –
হাউ মাউ খেয়ে ভরালাম পেট
সুবুন বর্ষাকে আমার ভাইধনের ক্ষেত।
জমিতেই ছিল ভাই। বোনের কথা শুনে ভাই ‘থ’। আজ নবান্ন। বাড়িতে পাঁচ রকম রান্না বান্না। নতুন চালের ভাত, পুকুরের বড় বড় মাছ, ক্ষেতের পাঁচ রকম সবজি, নানারকম তরিতরকারি। মিষ্টি। পায়েস। আরও কত কি। এলাহী আর তার বোন খেয়েছে কিনা খুদ চচ্চড়ি। এই খেয়েই তৃপ্ত বোন আশীর্বাদ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে নিজের ঘরে। ভাই দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। তারপর ভাই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে বৌকে বললে, ‘বৌ তোর মায়ের খুব অসুখ। কবিরাজ বলেছে তোর হাতের ভালো ভালো রান্না খেলে তবেই সে অসুখ সারবে। যত তাড়াতাড়ি প্যারিস ভালো ভালো রান্না করে এক্ষুনি আমাকে দে। দিয়ে আসি।’ ‘পোলাও কোর্মা কালিয়া মাছ মাংস লুচি মিষ্টি মণ্ডা মিঠাই যত প্যারিস।’
বৌ কোমরে কাপড় জড়িয়ে বললে, ‘ঠিক আছে।’ সঙ্গে সঙ্গে তৈরী পোলাও, কোর্মা, কালিয়া মাছ মাসন লুচি মণ্ডা মিঠাই আরও কত কি। বড় বড় চ্যাঙারি ভর্ত্তি করে দু-চারজন লোক নিয়ে ভাই সমস্ত কিছু নিয়ে গিয়ে ফেলল বোনের বাড়ি।
ভালো ভালো সুস্বাদু সব খাবাদ দাবার। খাবারের ভাঁজে ভাঁজে গাদা গাদা টাকা পয়সা সোনা দানা।
বোন বললে – ‘এত কিছু কেন?’
ভাই বললে, ‘ তোর ভাগ্যে আছে। তুই নে।’
বোন বললে – ‘এত কিছু কি আমরা খেতে পারি?’
ভাই বললে – ‘পাড়ার লোককে ডেকে এনে খাওয়া।’
বোন কোন কূল কিনারা খুঁজে পায় না।
ভাই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে হাত পা ছড়িয়ে দাওয়ায় বসে পড়ল। বৌ কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলে, ‘মা কেমন আছে?’
ভাই কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললে, ‘হায়! হায়! তোকে এক্ষুনি যেতে হবে। তোর মা তোকে দেখতে চায়। ‘
ভোজনং যত্রতত্র
শয়নং হট্টমন্দিরে
মরণং গোচিত্তিরে
ভূত ভবিষ্যৎ আরও কি আছে কপালে।
এক বামুন প্রতিদিন সকালে রাস্তা দিয়ে যায়। রাস্তার পাশেই ভাগাড়। ভাগাড়ে একটা মড়ার মাথা রোজ বামুনকে দেখে বলে –
ভোজনং যত্রতত্র
শয়নং হট্টমন্দিরে
মরণং গোচিত্তিরে
ভূত ভবিষ্যৎ আরও কি আছে কপালে।
বামুন প্রতিদিন মড়ার খুলির কথা শুনতে শুনতে চলে যায়। একদিন ভাবল মড়ার খুলি তাকে দেখে ররকম ভাবে বলে কেন? এর রহস্যটা তাকে জানতে হবে। এই ভেবে মড়ার খুলিটাকে বাড়িতে নিয়ে এল। বাড়িতে এনে মাটির হাঁড়িতে করে অনেক উঁচুতে শিকেয় তুলে রাখল। বামনী বলল. ‘ওটাতে কি আছে?’ বামুন বলল, ‘ওতে গোখরো স্যাপ আছে। হাত দেবে না।’ তারপর বামনী যখন থাকে না বামুন চেয়ে চেয়ে দেখে হাঁড়িটা ঠিক আছে কিনা।
বামনী ভাবে বামুন অত যত্ন করে হাঁড়িটা তুলে রেখেছে কেন? আর অমন আড়ে আড়ে চেয়ে চেয়ে হাঁড়িটাকে দেখে কেন? এই ভেবে হাঁড়িটাকে নামিয়ে দেখে তার ভেতর মড়ার খুলি। তখন ভাবল বামুনের ভালোবাসার রমণীর মাথার খুলি। বামুন এখনও ভুলতে পারে নি।
এই ভেবে খুলিটাকে ধ্যারন্ত বিষ্ঠায় ফেলে দিল।
বামুন তখন বুঝল খুলি তাকে কেন এমন করে বলত। মরার পরেও খুলির নিস্তার নেই। তারপরেও তাকে ধ্যারন্ত বিষ্ঠায় মাখামাখি হতে হল। এটাই খুলির নিয়তি।
প্রবাদ –
ভোজনং যত্রতত্র
শয়নং হট্টমন্দিরে
মরণং গোচিত্তিরে
ভূত ভবিষ্যৎ আরও কি আছে কপালে।
গৃহবধূ। কৃষিভিত্তিক জীবনে লেখালেখি তাঁর দিনযাপনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
গ্রামবাংলার হারিয়ে যেতে বসা সহস্রাধিক প্রবাদের সযতন সংগ্রাহক।
Comment here