আমার জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাটি বেশ ঝাঁ চকচকে মার্কশিটসহ উৎরে ফেলার উপলক্ষে সেবার গরম কালে বাবা আমাদের সবাইকে একটা দারুণ উপহার দিলো। টয়ট্রেনে টুরিস্ট স্পেশাল হেরিটেজ জয়রাইড। শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন থেকে গয়া বাড়ি স্টেশন অব্দি গিয়ে আবার ফেরত। চলবে হেরিটেজ কয়লার ইঞ্জিনে। সেটাই ছিল আমাদের প্রথম টয়ট্রেন চড়া। অথবা বলা চলে দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনে চড়া, কারণ তার বছর দেড়েক আগেই আমাদের সিমলার টয়ট্রেন চড়া সারা। বাবার অবশ্য দার্জিলিংয়ে মানুষ হওয়ার সুবাদে বহুকাল আগেই টয়ট্রেন চড়া শেষ।
তবে হলফ করে বলতে পারি, খোদ টয়ট্রেনের দেশে বাস করেও দার্জিলিং জেলার অনেক মানুষই আমাদের মত এতো বছর ধরে টয়ট্রেনেই চড়েনি। অবশ্য তার দুটো বড় কারণও আছে। এক হল সময়। যেখানে গাড়িতে করে এক ঘন্টায় কার্শিয়াং বা দু-আড়াই ঘণ্টায় দার্জিলিং পৌঁছন যায়, সেখানে আট-নয় ঘণ্টা ধরে টয়ট্রেন জার্নিটা একটু বাড়াবাড়িই বৈকি। হেরিটেজ স্পেশাল রাইডটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অন্য কারণটা হল যে গত কয়েক দশক ধরে বারংবার চেষ্টা করেও বিভিন্ন কারণে কখনো একটানা টয়ট্রেন চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এর জন্য যদিও মূলত বর্ষাকালে পাহাড়ের ধসকেই নন্দ ঘোষ ঠাউরানো হয়ে থাকে। তবে বর্ষাকালে পাহাড় কাঁদলেও অন্যসময় তাকে খুব একটা হাসতে দেখা গেছে কি? তা সে যেই কারণেই হোক না কেন, এই প্রজন্মের দার্জিলিং জেলার মানুষ বলতে গেলে তাই “দার্জিলিং কোসানোরেল”-এ আর পাঁচজনের মতোই “মেরে সপনো কি রাণী” অথবা হালের সঈফ বা শাহরুখ -এদের সাথেই চড়েছে।
গত হপ্তায় রেল দপ্তরের বদান্যতায় তরাই-ডুয়ার্স-পাহাড়বাসীর কপালে জোড়া শিকে ছিঁড়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর পুনরায় চালু হয়েছে টয়ট্রেন। সরকার-বেসরকার দুই সাহেব মিলে এই ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমানে UNESCO World Heritage তকমাপ্রাপ্ত দার্জিলিং-হিমালয় রেলকে চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। একই সাথে শিলিগুড়ি-ডুয়ার্সের রুটে চালু হয়েছে ভিস্তা ডোমকোচযুক্ত টুরিস্ট স্পেশ্যাল ট্রেন। ডুয়ার্সের এই রুটটা ভারতীয় রেলের অন্যতম সুন্দর রুটগুলোর মধ্যেএকটা হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু খুবই স্বল্প পরিচিত। অজানা উত্তরবঙ্গের মত এও অধরা বৈকি। এই রুটের সাথে উত্তরবঙ্গের মানুষের পরিচয় মূলত শিলিগুড়ি-ডুয়ার্স প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কল্যাণে। তবে আরেকটা ট্রেনও আছে, উত্তরের আদুরে মেয়ের নামে তার নাম। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। ডুয়ার্স ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে যারা নিউ মাল জংশন অথবা আলিপুরদুয়ার জংশনে নেমেছে, তারা বিলক্ষণ পরিচিত এই রুটের সাথে। সে অভিজ্ঞতা কথায় বলার নয়, এ জীবনেভোলার নয়। আমার মত ঘরছাড়া মানুষের পুজোয় বাড়ি যাওয়ার রুট। আমার প্রথম পরিচয় অবশ্য থিম্পু-পারো বেড়াতে যাওয়ার সময়।
শিলিগুড়ি জংশন ছাড়তেই ছবির মত সবুজ মোহুরগং-গুলমা চা বাগান, মধ্যে মধ্যে লাল নীল সবুজ অথবা টিনের চালাওলা উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি। তার পিছন দিয়ে উঠে গেছে মেঘের গয়নায় সেজে নীল পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঐ নীল পাহাড়ের পিছন দিয়েই দেখা মিলবে উত্তরের কন্যা কাঞ্চনের। দুচোখ ভরে দেখার আশ মিটতে না মিটতেই হুড়মুড় করে এসে পড়বে মহানন্দা নদীর বাঁক। গুলমা ব্রিজ পেরোতেই ট্রেন ঢুকে পড়বে ছবির মত সুন্দর সবুজে ঘেরা চম্পাসারি গ্রামে। এমন দৃশ্য কোথায় যেন দেখেছি? ছোট্টবেলায়, ঝুলনখেলায়?এসব ভাবতে ভাবতেই জঙ্গলের বুক চিরে ট্রেনএসে পড়বে সেবক স্টেশনে। আর স্টেশন ছাড়তেই ঝমঝম করে উঠে পড়বে সেবক রেলব্রিজে। তিস্তা পার করে সেবক পাহাড়কে পিছনে ফেলে ঢুকে পড়বে ডুয়ার্সের জঙ্গলে। দেখা মিললেও মিলতে পারে কৌতূহলী বনেরঅধিবাসীদের। জঙ্গল আর চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলবে সফর। দিগন্তরেখায় ছায়াসঙ্গীর মত থাকবে পাহাড়। নিউ মালজংশন,, চালসা স্টেশন তারা যেন ঠিক একেকটা জলছবি। তবে এই রুটের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের দিনের শেষের কষ্ট লাঘব করতে এরা কে কতটা সক্ষম, তা হেড আপিসই জানেন।
শিলিগুড়ি শহরে মোট তিনটে রেল স্টেশন। সকলের বহু পরিচিত নিউ জলপাইগুড়ির এবং স্বল্প পরিচিত শিলিগুড়ি জংশন। তবে শিলিগুড়ির সবচেয়ে পুরনো রেলস্টেশনটি কিন্তু অনেকের কাছেই অচেনা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনই ছিল শিলিগুড়ির প্রথম রেল স্টেশন এবং দার্জিলিং-হিমালয় রেলপথের উৎসস্থল। ব্রিটিশ বিদায় ও দেশভাগের পর কলকাতা থেকে আসা ব্রডগেজ রেলরুটের বেশ কিছুটা চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে যার ফলে ভারতীয় রেলপথের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অসম। তখন রেলপথ পুনর্নির্মাণের তাগিদে তৈরি হয় বাকি দুটো স্টেশন, টয় ট্রেনও অগত্যা পুরনো বাসা ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে এসে পড়ে নতুন ঠিকানায়। টাউন স্টেশন কালে কালে হয়ে দাঁড়ায় প্যাসেঞ্জার ট্রেন ও মালগাড়ি থামার স্টেশন। নবতম সংযোজনটাই হল এখনকার ব্যাস্ততম স্টেশন, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন –ভারতীয় রেলের অধীনস্থ একমাত্র স্টেশন যেখানেএক কালে ব্রড গেজ, মিটার গেজ এবং ন্যারো গেজ এই তিনটি গেজের লাইনই একসাথে সহাবস্থান করত।
তবে সবাই ভুলে গেলেও অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে এখনো শিলিগুড়ি শহরের বুকের ঠিক মধ্যিখানটা জুড়ে রয়েছে সে –শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন। সে দেখেছে এই শহরের জনবসতি থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে শহর হয়ে ওঠা। সে দেখছে শিলিগুড়ির শহর থেকে ভারতের একটি দ্বিতীয় স্তরের মেট্রো শহর হয়ে ওঠা। সে দেখেছে পরাধীন ভারত। সে দেখছে খন্ডিত ভারত। সে দেখেছে কেমন করে তার ভালোবাসার মানুষগুলো তাকে আঁকড়ে রেখেছে, হারিয়ে যেতে দেয়নি কাঁটাতারের ঐ পারে। সে সাক্ষী সেই দিনের যেদিন তার বুকের উপর দাঁড়িয়ে বাংলা মায়ের এক দামাল ছেলের দাপটে কোম্পানির সায়েবরা ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। থাক সে গল্প নাহয় পরের বার…? এইবারে শুধু ছোট্ট করে থাক উত্তরের রেল গেট হিসেবে শিলিগুড়ির পরিচয় পর্বটা।
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। উত্তরবঙ্গ জন্মভূমি এবং বর্তমানে কলকাতা কর্মভূমি। ভ্রমণপিপাসু এবং জ্ঞানপিপাসু।”
Comment here