-শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
[শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক লিখিত আত্মজীবনী ‘বিদ্যাসাগর-চরিত’ ১৮৪৮ সংবৎ আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম রচনা “বেতাল-পঞ্চবিংশতি” প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে। ইহা তাঁহার রচিত শেষ গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই পুস্তকে তাঁহার পূর্বপুরুষগণের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়াছেন, তাহা হইতে তাঁহার পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের চরিত্র চিত্রণ নিম্নে প্রদত্ত হইল। ইহাতে তাঁহার পিতার ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব অতি সুন্দর ভাবে প্রদর্শিত হইয়াছে।
বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙ্গালায় কমা বা পাদচ্ছেদের ব্যবহার অত্যন্ত বেশী রকম করিতেন। নিম্নে মুদ্রিত নিবন্ধটিতে তাহা আধুনিক বাঙ্গালার রীতি-বিরুদ্ধ বলিয়া কিছু কমাইয়া দেওয়া হইয়াছে।]
রামজয় তর্কভূষণ দেশত্যাগী (১) হইলেন; [তাঁহার পত্নী] দুর্গাদেবী পুত্র-কন্যা লইয়া বনমালিপুরের (২) বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই দূর্গাদেবীর লাঞ্ছনা-ভোগ ও তদীয় পুত্রকন্যাদের উপর কর্তৃপক্ষের অযত্ন ও অনাদর এতদূর পর্যন্ত হইয়া উহিল যে, দুর্গাদেবীকে পুত্রদ্বয় (৩) ও কন্যাচতুষ্টয় লইয়া পিত্রালয়ে যাইতে হইল। তদীয় ভ্রাতৃশ্বশুর (৩) প্রভৃতির আচরণের পরিচয় পাইয়া তাঁহার পিতা মাতা ভ্রাতা প্রভৃতি সাতিশয় দুঃখিত হইলেন, এবং তাঁহার ও তাঁহার পুত্রকন্যাদের উপর যথোচিত স্নেহ প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। কতিপয় দিবস সমাদরে অতিবাহিত হইল। দুর্গাদেবীর পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। এজন সংসারের কর্তৃত্ব তদীয় পুত্র রামসুন্দর বিদ্যাভূষণের হস্তে ছিল। সুতরাং তিনিই বাটীর প্রকৃত কর্তা ও তাঁহার গৃহিণীই বাটীর প্রকৃত কর্ত্রী। দেশাচার অনুসারে তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় ও তাঁহার সহধর্মিণী তৎকালে সাক্ষীগোপাল-স্বরূপ ছিলেন; কোনও বিষয়ে তাঁহাদের খাটিত না, সাংসারিক সমস্ত ব্যাপার রামসুন্দর ও তাঁহার গৃহিণীর অভিপ্রায় অনুসারেই সম্পাদিত হইত।
কিছু দিনের মধ্যেই পুত্র-কন্যা লইয়া পিত্রালয়ে কালযাপন করা দূর্গাদেবীর পক্ষে বিলক্ষণ অসুখের কারণ হইয়া উঠিল। তিনি ত্বরায় বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার ভ্রাতা ও ভ্রাতৃভার্যা তাঁহার উপর অতিশয় বিরূপ; অনিয়ত কালের জন্য সাতজনের ভরণ-পোষণের ভার বহনে তাঁহারা কোনও মতে সম্মত নহেন। তাঁহারা দুর্গাদেবী ও তদীয় পুত্র-কন্যাদিগকে গলগ্রহ বোধ করিতে লাগিলেন। রামসুন্দরের বনিতা কথায়-কথায় দুর্গাদেবীর অবমাননা করিতে আরম্ভ করিলেন। যখন নিতান্ত অসহ্য বোধ হইত, দুর্গাদেবী স্বীয় পিত তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের গোচর করিতেন। তিনি সাংসারিক বিষয়ে বার্ধক্য-নিবন্ধন ঔদাসীন্য অর্থবা কর্তৃত্ব-বিরহ-বশতঃ, কোনও প্রতিবিধান করিতে পারিতেন না। অবশেষে দুর্গাদেবীকে পুত্র-কন্যা লইয়া পিত্রালয় হইতে বহির্গত হইতে হইল। তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় সাতিশয় ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হইলেন, এবং স্বীয় বাটীর অনতিদূরে এক কুটীর নির্মিত করিয়া দিলেন। দুর্গাদেবী পুত্র-কন্যা লইয়া, সেই কুটীরে অবস্থিতি ও অতিকষ্টে দিনপাত করিতে লাগিলেন।
ঐ সময় টেকুয়া (৪) ও চরখায় (৫), সূতা (৬) কাটিয়া সেই সূতা বেচিয়া অনেক নিঃসহায় নিরুপায় স্ত্রীলোক আপনাদের গুজরান (৭) করিতেন। দুর্গাদেবী সেই বৃত্তি অবলম্বন করিলেন। তিনি একাকিনী হইলে, অবিলম্বে বৃত্তি দ্বারা অবলীলাক্রমে দিনপাত করিতে পারিতেন। কিন্তু তাদৃশ স্বল্প আয়ের দ্বারা নিজের দুই পুত্রের ও চারি কন্যার ভরণ-পোষণ সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নহে। তাঁহার পিতা সময়ে-সময়ে যথাসম্ভব সাহায্য করিতেন; তথাপি তাঁহাদের আহারাদি সর্ব বিষয়ে ক্লেশের পরিসীমা ছিল না। এই সময়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম ১৪।১৫ বৎসর। তিনি মাতৃদেবীর অনুমতি লইয়া উপার্জনের চেষ্টায় কলিকাতা প্রস্থান করিলেন।
সভারাম বাচস্পতি নামে আমাদের এক সন্নিহিত জ্ঞাতি কলিকাতায় বাস করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র জগন্মোহন ন্যায়ালঙ্কার, সুপ্রসিদ্ধ চতুর্ভুজ ন্যায়রত্নের নিকট অধ্যয়ন করেন। ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়, ন্যায়রত্ন মহাশয়ের প্রিয় শিষ্য ছিলেন; তাঁহার অনুগ্রহে ও সহায়তায় কলিকাতায় বিলক্ষণ প্রতিপন্ন (৮) হয়েন। ঠাকুরদাস ও সন্নিহিত জ্ঞাতির আবাসে উপস্থিত হইয়া আত্মপরিচয় দিলেন, এবং কি জন্য আসিয়াছেন, অশ্রুপূর্ণ-লোচনে তাহা ব্যক্ত করিয়া, আশ্রয়-প্রার্থনা করিলেন। ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের সময় ভাল, অকাতরে অন্নব্যায় করিতেন; এমন স্থলে, দুর্দশাপন্ন আসন্ন (৯) জ্ঞাতি-সন্তানকে অন্ন দেওয়া দুরূহ ব্যাপার নহে। তিনি সাতিশয় দয়া ও সবিশেষ সৌজন্য প্রদর্শন-পূর্বক, ঠাকুরদাসকে আশ্রয় প্রদান করিলেন।
ঠাকুরদাস প্রথমতঃ বনমালিপুরে, তৎপরে বীরসিংহে, সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ (১০) পড়িয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের চতুষ্পাঠীতে রীতি-মত সংস্কৃত বিদ্যার অনুশীলন করিবেন, প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা স্থির হইয়াছিল; এবং তিনিও তাদৃশ অধ্যয়ন-বিষয়ে সবিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, সংস্কৃত-পাঠে নিযুক্ত হইলে তাহা সম্পন্ন হয় না। তিনি সংস্কৃত পড়িবার জন্য সবিশেষ ব্যগ্র ছিলেন, যথার্থ বটে, এবং সর্বদাই মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করিতেন, যত কষ্ট যত অসুবিধা হউক না কেন, সংস্কৃত-পাঠে প্রাণপণে যত্ন করিব; কিন্তু জননীকে ও ভাই-ভগিনীগুলিকে কি অবস্থায় রাখিয়া আসিয়াছেন, যখন তাহা মনে হইত, তখন সে ব্যগ্রতা ও সে প্রতিজ্ঞা তদীয় অন্তঃকরণ হইতে একেবারে অপসারিত হইত। যাহা হউক, অনেক বিবেচনার পর অবশেষে ইহাই অবধারিত হইল, যাহাতে তিনি শীঘ্র উপার্জন-ক্ষম হন , সেরূপ পড়া-শুনা করাই কর্তব্য।
এই সময়ে, মোটামুটি ইংরেজী (১১) জানিলে, সওদাগর (১২) সাহেব-দিগের হৌসে (১৩) অনায়াসে কর্ম হইত।
এজন্য সংস্কৃত না পড়িয়া, ইংরেজী পড়াই তাঁহার পক্ষে পরামর্শ-সিদ্ধ হইল। কিন্তু সে সময়ে ইংরেজী পড়া সহজ ব্যাপার ছিল না। তখন এখনকার মত প্রতি পল্লীতে ইংরেজী বিদ্যালয় ছিল না। তাদৃশ বিদ্যালয় থাকিলেও, তাঁহার ন্যায় নিরুপায় দীন বালকের তথায় অধ্যয়নের সুবিধা ঘটিত না। ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের পরিচিত এক ব্যক্তি কার্যোপযোগী ইংরেজী জানিতেন। তাঁহার অনুরোধে ঐ ব্যক্তি ঠাকুরদাসকে ইংরেজী পড়াইতে সম্মত হইলেন। তিনি বিষয়-কর্ম্ম করিতেন; সুতরাং, দিবা-ভাগে তাঁহার পরিবার অবকাশ ছিল না। এজন্য তিনি ঠাকুরদাসকে সন্ধ্যার সময় তাঁহার নিকটে যাইতে বলিয়া দিলেন। তদনুসারে ঠাকুরদাস প্রত্যহ সন্ধ্যার পর তাঁহার নিকটে গিয়া ইংরেজী পড়িতে আরম্ভ করিলেন।
ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের বাটীতে সন্ধ্যার পরেই উপরিলোকের (১৪) আহারের কান্ড শেষ হইয়া যাইত। ঠাকুরদাস ইংরেজী পড়ার অনুরোধে সে সময়ে উপস্থিত পারিতেন না; যখন আসিতেন, তখন আর আহার পাইবার সম্ভাবনা থাকিত না, সুতরাং তাঁহাকে রাত্রিতে অনাহারে থাকিতে হইত। এইরূপে নক্তন্তন (১৫) হরে বঞ্চিত হইয়া তিনি দিন-দিন শীর্ণ ও দুর্বল হইতে লাগিলেন। একদিন তাঁহার শিক্ষক জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এমন শীর্ণ ও দুর্বল হইতেছ কেন? তিনি, কি কারণে তাঁহার সেরূপ অবস্থা ঘটিতেছে, অশ্রুপূর্ণ নয়নে তাহার পরিচয় দিলেন। ঐ সহরে সেই স্থানে ঐ শিক্ষকের আত্মীয় শূদ্র-জাতীয় এক দয়ালু ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সবিশেষ অবগত হইয়া তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন, এবং ঠাকুরদাসকে বলিলেন, যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে আর তোমার ওরূপ স্থানে থাকা কোনও মতে চলিতেছে না। যদি তুমি রাঁধিয়া খাইতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাকে আমার বাসায় রাখিতে পারি। এই সদয় প্রস্তাব শুনিয়া ঠাকুরদাস যার-পর-নাই (১৬) আহ্লাদিত হইলেন, এবং পরদিন অবধি তাঁহার বাসায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
(ক্রমশঃ)
Comment here