আঙিনা

দেশ – ১৯

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

সে সময়ের একজনের নাম না নিলে বিপ্লব অসম্পূর্ণ থাকবে। উল্কার বেগে উত্থান তাঁর। প্রস্থানও আচম্বিতে। ১৯৭৪ এ মৃত্যু হয়। তিনি হলেন শ্রী সুবোধ ব্যানার্জি। ১৯৬৭ সালে উনি বামফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় শ্রমমন্ত্রী হয়েছিলেন। উনি দুটো উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। একঃ কলকাতা শহর থেকে ইংরেজ শাসক দের স্ট্যাচু গুলো উৎখাত করেছিলেন। দুইঃ কুখ্যাত ঘেরাও আন্দোলনের আবিস্কারক। এখনো ঘেরাও আন্দোলন বেঁচে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অন্যত্র।

আজ একটা সত্য কাহিনী বলি। আলিবর্দী একবার লন্ডন গেছেন সাথে পুত্র আর যতীন চক্কোত্তি। সরকারী পয়সায় NRI Investor ধরে আনতে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যতীন বাবু দেখলেন সপুত্র বাবু কোথাও বেরিয়েছেন। ওনারা ফিরে আসার পর যতীন বাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন তা সকালে কোথায় গেছিলেন? ছোট্ট উত্তর এল ব্যাংকে। এটা বরুণ সেনগুপ্ত রসিয়ে রসিয়ে পেপারে লিখেছিলেন। যতীন বাবু এর প্রতিবাদ করেননি। মারাত্মক ভুল করেছিলেন। এছাড়া উনি বেঙ্গল ল্যাম্পের বিষয়টা জনসমক্ষে আনেন। গর্হিত অপরাধ। অনেকদিন পরে ( exact chronology মনে নেই)।

দিল্লিতে একটা লনওয়ালা একতলা বাড়ীতে বাস করতেন একটি বাঙালি পরিবার। হাজবান্ড, ওয়াইফ ও নার্সারি তে পাঠরতা একটি ছোট্ট কন্যা। একদিন খুব সকালে ভদ্রলোকের কোথাও জরুরি কাজ থাকায় বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে বলে যান তাঁর ফিরতে দেরী হবে। একজনকে বলে রেখেছি সে এসে বাড়ির পেছনটা সাফ করবে, জঙ্গল হয়ে রয়েছে। বিকেল চারটে নাগাদ কাজের মেড এল বিকেলের কাজ করতে। দেখল বাইরের গেট খোলা। বাড়ির দরজা খোলা। ভেতরের ঘরে ম্যাম শুয়ে আছেন। তাঁর গলা কাটা। একটা দিকে মেঝেতে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে, অন্য পাশে শিশুকন্যাটি পুতুল নিয়ে খেলছে।

দুপুরে বাচ্চাটি স্কুল থেকে ফিরে গেট দুটো খোলা পেয়ে ঘরে ঢোকে। মা কে ডেকে সাড়া না পেয়ে পুতুল নিয়ে খেলতে বসে যায়। হাজব্যান্ড এসে আগে যেটা লিখলাম সেটাই বললেন। কলকাতা দিল্লী তে হৈচৈ পড়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বললেন এর তদন্ত হবে ভাল করে। আমার ধারণা যতীনবাবু সাপের লেজে পা দিয়ে ভুল করেছিলেন। সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল আলিবর্দী খান। হাজবান্ড কে একবছরের জন্য রিম্যান্ডে নিলে কিছু বার হতে পারতো। উনি একটা অচেনা অজানা যুবক কে আগাছা পরিস্কার করতে বলে নিজে সকাল সকাল বেরিয়ে গেলেন। আগাছা সাফ করতে ধারালো অস্ত্র লাগে ( পার্টির সিম্বল কাস্তে)। ছুটির দিনেও তো করা যেত, যখন উনি ঘরে থাকতেন। হয়তো ওনাকে ভয় দেখানো হয়েছিল।
সময়টা মনে নেই। একটা সিরিয়াল চলছিল বাহান্ন এপিসোড। এবিপি প্রডিউসার ছিল। গল্পে ছিল এক মন্ত্রীর বিবাহিত পুত্রের সাথে এক অভিনেত্রী প্রেম। ( চন্দনের সাথে আল্পনা গোস্বামীর পেরেম গাথা) আলিবর্দী এটা চলতে দেয়নি। মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ( আল্পনা কে USA পাঠানো হয়েছিল)।

১৯৬২ তে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধান চন্দ্র রায়ের মৃত্যু হয়। অত বড় ব্যক্তি, ব্যক্তিত্ব, চিকিৎসকের মৃত্যু বাংলার রাজনীতির অঙ্গনে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করল। সিপিআই সমেত কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজনীতির জমি দখলের লড়াইয়ে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন প্রফুল্ল চন্দ্র সেন। ভালো মানুষ, গান্ধীবাদী নেতা। কাঁচকলা প্রেমী। উনি হাঁপানির ওষুধ দিতেন। আয়ুর্বেদিক। কাঁচকলায় পুরে ওষুধ দিতেন। লোকজন আসত ওষুধ নিতে। সেই সময় সারা ভারত, এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে খাদ্য সংকট চলছিল। বাংলায় চালের ওপর খুব রেস্ট্রিকশন ছিল। লোকাল ট্রেনে করে চাল পাচার হত। সেইসময় প্রফুল্ল সেন জনগনের উদ্দেশ্যে বললেন ভাতের বদলে সবাই কাঁচকলা খাওয়া শুরু করুন।

জনরোষাগ্নীতে ঘী ঢাললেন। তখনকার দিনে বাংলার মানুষ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশী রাজনীতি সচেতন ছিলেন। স্পষ্টবাদী সুভাষ বোসকে দেখেছে। তাই ধূর্ত গান্ধী ও নেহরুর ধাপ্পাবাজীটা বাঙালিরা ধরে ফেলেছিল। গান্ধী নোয়াখালী গেছিল দুটো নধর ছাগল নিয়ে , রোজ ছাগলের দুধ চাই ওনার। ওখানে গিয়ে কি বললেন, মা বোনেরা ওরা ( মুসলিম রা) রাতে যখন রেপ করতে আসবে, দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে পড়বে। বাধা পেলে তোমাদের পুরুষ দের ওরা মেরে ফেলবে। গঠন হওয়ার পর পাকিস্তান অর্থের সমস্যায় পড়েছিল। ভারত সরকার কোনো সাহায্য দিতে অস্বীকার করে, তখন করমচাঁদ অনশনে বসেন। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয় সাহায্য দিতে।

রঙ্গীলা রসুল কাহানী তে করমচাঁদের ভূমিকা সবাই জানেন। ভগতসিং এর জন্য কোনো আপীল করতে অস্বীকার করেন। দেশ ভাগের সময় নেহেরু প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে সম সংখ্যকজন ট্রান্সফার হবে বলেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। প্রায় দুকোটি হিন্দু এপারে এসেছিলেন রিক্ত অবস্থায়। সে তুলনায় খুবই অল্প সংখ্যক মুসলমান এদেশ থেকে ওপারে গেছিল। নেহরুকে এবিষয়ে বলা হলে ও উত্তর দেয়নি। শ্যামাপ্রসাদজী কে কাশ্মীরের জেলে পাঠিয়ে নেহরু লন্ডনে গেলেন দুমাসের জন্য, যুবরাজের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে। নাকি এডুইনার পেছনে ঘুরঘুর করতে। দুমাস ভাবা যায়!?

এই সব গৌরচন্দ্রিকার কারণ হল ১৯৬২ তে বিধান রায়ের মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং কংগ্রেসের বিশ্বসযোগ্যতা তলানিতে এসে পৌঁছেছিল। কংগ্রেস-বিরোধী নানা রঙের দলগুলি একজোট হয়ে ১৯৬৭ এ ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছিল। যদিও অল্প সময়ের মধ্যে তিনবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল। ১৯৭২ এ কংগ্রেস সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ব্যাপক রিগিং করে ক্ষমতা দখল করে। এই শাসনকালে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি , সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সোমেন মিত্রর মত যুবনেতার উত্থান হয়েছিল।

কলকাতার অফিসবাবুরা পেয়েছিল মিনিবাস, যাতে বসে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আপিস যেত। পরে দাঁড়িয়ে যাওয়া অনুমতি পায়, আর কলকাতা পায় কলারওয়ালা মানুষ। স্পন্ডিলাইটিস। ভারত পেয়েছিল রাজধানী এক্সপ্রেস, দিল্লীর সাথে সব রাজ্যগুলির রাজধানী গুলো যুক্ত হয়েছিল।

১৯৭২ – ৭৭, রুনু গুহ নিয়োগীর উল্কা উত্থান। দমদম দাওয়াই। হেমন্ত বোস হত্যা শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে। নকশাল বুদ্ধিজীবী সরোজ দত্তের ময়দানে ভোররাতে এনকাউন্টার। সাক্ষী উত্তমকুমারের বোম্বে পলায়ন।শেষ পর্যন্ত চারু মজুমদার গ্রেফতার ও মৃত্যু। অবাস্তব অলীক দুঃস্বপ্নের পরিসমাপ্তি। ভারতবর্ষ ও ভারতবাসী সম্মন্ধে সম্যক ধারণার বিশাল অভাব। রকেটের গতিতে উত্থান ভারতীয় রাজনীতিতে, শেষে মৃত্যু হল ওই আকাশেই। সঞ্জয় গান্ধী। জনশ্রুতি আমেরিকান মতবাদের দিকে ঝুঁকছিলেন, কেজিবি সেটা রোধ করল পারমিশন নিয়ে।

আগে একটা পর্বে হাসপাতাল নিয়ে লিখেছি। বলেছিলাম এককালে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক শরীর খারাপ হলে হাসপাতালেই যেতেন। ৭৭ এর পর বঙ্গেশ্বর হাসপাতাল হেডদের নিয়ে করা মিটিংএ জিজ্ঞাসা করলেন সব কেমন চলছে। হেডগণ মাথা প্রায় মাটিতে নুইয়ে কইলেন স্যার পেরায় সব হাসপাতালের প্রলেতারিয়েত রাজ পতিষ্টিত হয়েছে।

কি রকম, কিরকম? স্যার সর্বত্র ওয়ার্ড বয় বা ফোর্থ কেলাস স্টাফেদের কথাই শেষ কথা। কে বেড পাবে, কে প্যাসেজে জায়গা পাবে সব ওরাই ঠিক করে। জুনিয়র ডাক্তাররা তো থরহরি কম্পমান, ওদের স্যার বলে ডাকে। বটে বটে এত তাড়াতাড়ি এত উন্নতি? শুধু তাই নয় বড় বড় ডাক্তার রাও ওদের সমীহ করে চলেন। ওরা রেট চার্টও বানাতে শুরু করেছে। বেড, প্যাসেজের রেট, ছেলে বা মেয়ে হলে, মুখ দেখার রেট ইত্যাদি ইত্যাদি। বাহ বড় ভালো খবর শোনালে। দেখো একদিন এই হাসপাতালগুলো কৃষক শ্রমিকদের পথ দেখাবে।

ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়। একজন বৈজ্ঞানিক তথা ডাক্তার ছিলেন। তিনি কুষ্ঠরোগের ওপর অনেকদিন ধরে রিসার্চ করছিলেন। তার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে টেস্ট টিউব বেবি তৈরীর উপাদান বের করে ফেলেন। সেটি তিনি তাঁর উপরওয়ালাদের না জানিয়ে এক আগরওয়াল মহিলার ওপর প্রয়োগ করেন। ভদ্রমহিলা বহু বছর ধরে সন্তানহীন ছিলেন। ডঃ মুখার্জীর মেথড ফলো করে ভদ্রমহিলা একটি টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেন। কন্যা সন্তান। দূর্গা। এটি ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি।

ডঃ মুখার্জি পুরো প্রসিডিওরটা একটা পেপার আকারে লিখে একটি ফরেন জার্নালে পাঠালেন। ওরা ফ্যাক্ট এবং ডাটা ভেরিফাই করার জন্য কনসার্নড অথোরিটি কে রিপোর্ট পাঠাতে বললেন। সেই চিঠি হাত ঘুরে বঙ্গেশ্বরের টেবিলে এল। উনি সাথে সাথে আমলা, হাসপাতালের অনুগত প্রধানদের মিটিংএ ডাকলেন। প্রথমেই বললেন পার্টি, সরকারকে না জানিয়ে এত বড় একটা আবিষ্কার প্রকাশ করা যায়? রাশিয়া হলে এতক্ষনে…….উনি প্রধান দের জিজ্ঞাসা করলেন এতবড় একটা ঘটনা চুপচাপ লোক না জানিয়ে করা সম্ভব? অনুগত মাথা নোয়ানো পোধানরা, যেনাদের সঙ্গে রিসার্চের দূরত্ব ছিল উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর দূরত্বের সমান। এমনকি ডাক্তারিটাও ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে করান।

নিজেরা কেউ কবিতা ল্যাখেন, কেউ ছবি আঁকেন, ছবি বানান অর্থাৎ সামাজিক সান্ধ্য সভাসমিতিতে সভা আলো করে বিপুল প্রসন্নতা অনুভব করেন। সেই তেনারাই এক সাথে ঘাড় নেড়ে জানালেন সুভাষ মুখার্জি ভূয়ো দাবী করেছেন। আপনি একটা কমিটি তৈরী করে দিন , কমিটি প্রমাণ করে দেবে ওনার রিসার্চ ভূয়ো। তা উনি একটা কমিটি বানিয়ে দিলেন। কমিটিতে রেডিও ফিজিক্সের একজন বশংবদ প্রফেসরকেও রাখা হয়েছিল। সেইসব বশংবদ পোধানদের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। মুখবইতে মুখ দেখা যায়।

সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী একটি উপন্যাসে ডিটেলসে সব কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন। তপন সিনহা এই কাহিনী নিয়ে একটি সিনেমা বানান ‘এক ডক্টর কি মৎ’। কমিটি ভীষণ অপমান করল সুভাষবাবুকে। এর কিছুদিন পরে ১৯ শে জুন ১৯৮১ তে সুভাষ বাবু আত্মহত্যা করেন। ডাঃটিসি আনন্দ টেস্ট টিউব বেবিকরতে সফল হন। তিনি নিজে জানান ভারতে প্রথম ও বিশ্বে দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবির সৃস্টিকর্তা ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

বঙ্গেশ্বরকে লাথালেও তো সুভাষবাবু ফিরে আসবেন না।

 

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here